দেশের সময়: ভাষা মুছে দিল কাঁটাতারের বেড়া। মিলে গেল দুই বাংলা। কারও হাতে ছিল বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। কারও গালে আঁকা অ-আ-ক-খ। দেশভাগের যন্ত্রণা ভুলতে তাঁরা আঁকড়ে ধরলেন মাতৃভাষা বাংলাকে। অমর একুশে উদ্যাপন ঘিরে পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ড আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠল ভারত-বাংলাদেশের মিলনক্ষেত্র।
মাতৃভাষার জন্য শহিদ হওয়া বীরদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আবেগ দখল নিল কণ্ঠের। দুই বাংলার অগণিত মানুষকে সাক্ষী রেখে শিল্পী থেকে কবি, সাহিত্যিক প্রত্যেকেই বললেন, দুই বাংলাই আমাদের দেশ। আমাদের রক্তে, মজ্জায় প্রথীত হয়ে আছে দুই বাংলাই। চলল কোলাকুলি, মিষ্টি বিতরণ।
ভোর থেকে অপেক্ষা করছিলেন লিলি ভট্টাচার্য। এসেছেন ডানকুনি থেকে। নিরাপত্তারক্ষীদের অনেক অনুরোধ করার পর অবশেষে সীমান্ত পেরনোর অনুমতি মেলে। ততক্ষণে জিরো পয়েন্টে শুরু হয়ে গিয়েছে অনুষ্ঠান। অনুমতি মিলতেই একছুটে দৌড় লিলির। মুখে এক গাল হাসি। বললেন, ঢুকতে না পেরে দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
নিরাপত্তা বড় বালাই। তাই মিলেও যেন মিলল না পুরোটা। দু’পাড়ের ভাষা একটাই।
কিন্তু দেশ ভিন্ন। তাই সীমান্তের দু’পাড়ে আলাদা আলাদা মঞ্চ করা হয়েছিল। তাতে কী। ভাষার আবেগের কাছে ধোপে টেকে না নিরাপত্তার কড়াকড়ি। আর তাই সকাল দশটায় গেট খুলতেই এন্ট্রি পাস নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েন দু’পাড়ের মানুষজন।
ভাষার টানে এই প্রথমবার সীমান্তের অমর একুশে উদ্যাপনে যেমন উপস্থিত হয়েছিলেন এপার বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিক দেবারতি মুখোপাধ্যায়, তেমনই যোগ দিয়েছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মোহিনী বিশ্বাস। শুধু ভাষা নয়, রং তুলিতেও যখন মিলে যায় দুই বাংলার ভাবনার আবেগ, তখন আলাদা উন্মাদনা বহন করে। শিল্পী মোহিনী বিশ্বাসের আঁকা ছবি একুশের স্মারক হিসেবে তুলে দেওয়া হল বাংলাদেশের সমবায় মন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের হাতে। কথা দিলেন, এই ছবি তিনি তুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে।
মোহিনীর কথায়, এটা অনুভূতির টান। হৃদয়ের যোগাযোগ।
যশোরের সাংসদ শেখ আফিলুদ্দিন এই বিশেষ দিনে ভারতের বন্ধুদের জন্য উপহার হিসেবে অতিথিদের হাতে তুলে দিলেন বাংলাদেশের মিষ্টি ৷
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠানো পুষ্পস্তবক তাঁর হয়ে শহিদ বেদিতে অর্পণ করেন বনগাঁ পুলিশ জেলার সুপার জয়িতা বোস। সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে শহিদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান গোপাল শেঠ। ছিলেন ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়েতের প্রধান প্রসেনজিৎ ঘোষ, বাগদার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস।
জয়ন্তিপুর বাজার থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করে সীমান্তে যান বনগাঁর স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা।
দেবারতি বলেন, দেশভাগ আমাকে বড্ড কষ্ট দেয়। যন্ত্রণাবিদ্ধ করে। কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, যতই কাঁটাতার দেওয়াল তুলুক। দুই বাংলার আবেগকে কোনও কিছু দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না।
যে ভাষাতে মাকে মা বলে ডাকতে পারি, এর চেয়ে বড় সুখ আর কীসে হয়! তাই সেই ভাষাকে রক্ষা করতে এক জোট হয়ে লড়াই চালিয়েছিল বাঙালি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। লক্ষ্য ছিল একটাই, বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা। সেই লক্ষ্যপূরণে রক্ত ঝরেছে। খালি হয়েছে বহু মায়ের কোল। কিন্তু দামাল সন্তানরা তাঁদের লড়াই ছাড়েননি সেদিন। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তাঁরা যে জয় নিয়ে এসেছিল সেদিন, সেই জয়ের নাম অমর একুশে। সেই একুশের সকালে এক অন্য আবেগের ইতিহাস গড়ল পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত।