দেশের সময়: ইন্ডিয়া জোটে ‘অসম্মানিত’ হতে হচ্ছে। সরাসরি এমনই অভিযোগ করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকী তিনি আর ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে থাকবেন না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল কোনও জোট করবে না বলেও সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। মমতার এই একলা চলো নীতিতে ইন্ডিয়া জোটে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। কেন বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়া সম্ভব নয়, তা নিয়ে ঠারেঠোরে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের দিকেই আঙুল তুলেছেন মমতা।
অন্যদিকে, জোট নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, কেন জোট হচ্ছে না, সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বলতে পারবেন। এই পরিস্থিতিতে ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা নিয়ে বাংলার ঢোকার পরই কর্মসূচি কাটছাঁট করে বিমানে চেপে দিল্লি ফিরে গিয়েছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তিনি আর বাংলায় ওই কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসবেন কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে ঘোর সংশয়। রাহুল উত্তরবঙ্গ কর্মসূচির মাঝপথেই দিল্লি ফিরে যাওয়ায় কংগ্রেস কর্মীরা হতাশ। যদিও অধীর চৌধুরীরা তাঁদের আশ্বাস দিয়েছেন, ২৮ জানুয়ারি রাহুল গান্ধী আবার উত্তরবঙ্গে আসবেন।
জলপাইগুড়ি দিয়ে যাত্রা শুরু করবেন। কংগ্রেসের প্রদেশ নেতৃত্ব চাইছে, রাহুলকে দিয়ে উত্তরবঙ্গে একটি বড় র্যালি কিংবা জনসভা করাতে। কিন্তু তা নিয়েও বিস্তর জলঘোলা শুরু হয়েছে। শিলিগুড়িতে রাহুলের সভার জন্য প্রশাসনিক অনুমতি মেলেনি। ফলে শেষ পর্যন্ত রাহুল গান্ধী আদৌও আর বঙ্গে আসবেন কি না, তা নিয়ে দেখা গিয়েছে ঘোর অনিশ্চয়তা। এদিকে, জোট নিয়ে এই ডামাডোলের মাঝেই মমতার উত্তরবঙ্গ সফরে যাওয়ার কথা। সেখানে গিয়ে তিনি কী বলেন, সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে রাজনৈতিক মহল।
এদিকে, নীতীশ কুমারও পুরনো তিক্ততা ভুলে বিজেপির হাত ধরতে চাইছেন। বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে তিনি বিহারে আরজেডি-কংগ্রেসের সহযোগী হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, নীতীশ কুমারের ডিএনএ-তে সমস্যা রয়েছে। জবাব এসেছিল জেডিইউ-র তরফেও। সেই তিক্ততাপর্ব ভুলে দেড় বছরের মাথায় মহাগঠবন্ধন ছেড়ে আবার বিজেপির সহযোগী হতে চলেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। নীতীশ ঘনিষ্ঠরা ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন। বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী হলেও নীতীশ কুমার স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছিলেন না। বারবার বাধার মুখে পড়তে হচ্ছিল। কিন্তু কাদের বাধা? তা নিয়ে সরাসরি নাম না করলেও নিশানা আরজেডি-র দিকেই।
অন্যদিকে, ২৯ অথবা ৩১ জানুয়ারি ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে আর্থিক মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তারিখ দিয়েছে ইডি। হেমন্ত সোরেন যদি এই তারিখ দু’টি এড়িয়ে যান, তাহলে তাঁর বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে ইডি সূত্রে খবর। এই মর্মে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার নেতাকে চিঠিও পাঠিয়েছে ইডি। অর্থাৎ মমতা বেসুরো হতেই ইন্ডিয়া জোট ভেঙে দিতে মরিয়া বিজেপি। এক্ষেত্রে কখনও দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক টোপ। কখনও আবার কাজে লাগানো হচ্ছে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে, এমনটাই অভিযোগ বিরোধীদের।
বিজেপিকে হারাতে ইন্ডিয়া জোটে বরাবর আঞ্চলিক দলগুলির উপর গুরুত্ব দিতে বলেছেন মমতা। তাঁর যুক্তি, যে রাজ্যে যে দল শক্তিশালী, তাকে সামনে রেখেই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। বাকিদের সমর্থন দিতে হবে ওই দলকে। কিন্তু ইন্ডিয়া জোটে তাঁকে যোগ্য সম্মান দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস ও সিপিএমকে এক আসনে বসিয়ে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন মমতা।
রাম মন্দির উদ্বোধনের দিন কলকাতায় সর্বধর্ম সমন্বয়ে মিছিল করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানেই তাঁর বক্তব্যে ইন্ডিয়া জোটের প্রসঙ্গ উঠে আসে। তৃণমূল নেত্রী বলেন, আমি ইন্ডিয়া নাম দিয়েছি। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক নিয়ন্ত্রণ করছে সিপিএম। যে সিপিএম আমাদের উপর ৩৪ বছর ধরে অত্যাচার করেছে, যাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি, এখন তাদের উপদেশ আমি মানব কেন? এ প্রসঙ্গেই মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, সিপিএমের সঙ্গে জোট করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
অন্যদিকে, সিপিএম নেতৃত্বও সাফ জানিয়ে দিয়েছে, বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে তাদের কোনও জোট ছিল না। হবেও না। এই পরিস্থিতিতে ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল ইন্ডিয়া জোটের ভবিষ্যত।
জোট নিয়ে মমতার ব্যাখ্যা, ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে আমি বলেছিলাম, তোমরা ৩০০ আসনে লড়াই করো। বাকি আসনগুলি আঞ্চলিক দলগুলিকে ছেড়ে দেওয়া হোক। কিন্তু ওরা নিজেদের মর্জিমতো চলছে। আমি তোমাদের আসন নিতে যাব না। কিন্তু ওরা যা ইচ্ছে, তাই করবে বলছে। এই প্রেক্ষাপটেই মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেসের আচরণ কার্যত গেরুয়া শিবিরকে সাহায্য করে দেওয়া। মমতার কথায়, বিজেপিকে কোনওভাবে মদত নয়, তাহলে কেউ ক্ষমা করবে না, আমিও না। আমি রক্ত দেব, কিন্তু বিজেপিকে একটা আসনও ছাড়ব না। যদিও জোট ভেস্তে যাওয়ার পথে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশের কটাক্ষ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে যাই বলুন না কেন, বিজেপিকে সাহায্য করে দিতেই ইন্ডিয়া জোট ভেঙে দিতে চাইছেন।
তিনটি স্ট্র্যাটেজির উপরই এখন তৃণমূল পাখির চোখ করেছে। কেন্দ্রীয় বঞ্চনা, নারী বিদ্বেষ ও ধর্মীয় রাজনীতি। তৃণমূল নেতারা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, বাংলার প্রাপ্য টাকা দিচ্ছে না কেন্দ্র। প্রাপ্য আদায়ে দিল্লিতে পর্যন্ত দরবার করেছে মমতা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলার হকের টাকার দাবি জানিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা, গ্রাম সড়ক যোজনা সহ একাধিক প্রকল্পে কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ। সবমিলিয়ে এক লক্ষ কুড়ি হাজার কোটি টাকার মতো কেন্দ্রের কাছে প্রাপ্য রয়েছে বাংলার। যার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ১০০ দিনের কাজ। প্রায় ৭ হাজার কোটি বেশি প্রাপ্য রয়েছে। কিন্তু ১০০ দিনের কাজ করা শ্রমিকরা বঞ্চনার শিকার। তাঁদের প্রতি কেন্দ্রের কোনও সহানুভূতিশীল মনোভাব নেই বলে অভিযোগ তৃণমূলের।
গ্রামবাংলার মানুষ পরিশ্রম করেও তাঁদের পকেটে ন্যায্য প্রাপ্য জোটেনি, এটাকেই সামনে রেখে ভোটে যেতে চাইছে তৃণমূল নেতৃত্ব। দ্বিতীয়ত, নারী বিদ্বেষ। মণিপুরের অশান্ত পরিস্থিতির কথা সকলেরই জানা। নারী জাতির উপর সেখানে কীভাবে লাঞ্ছনা নির্যাতন হয়েছে তা গোটা দেশ দেখেছে।
এছাড়া উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরা সহ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে নারীদের অসম্মান লাঞ্ছনা, বঞ্চনার ধারাবাহিক কাহিনী লোকসভা নির্বাচনের ময়দানে তুলে ধরতে চাইছে তৃণমূল। তৃতীয়ত, ধর্মের নামে রাজনীতি। তৃণমূলের অভিযোগ, রাজনৈতিকভাবে যখন বিজেপি পেরে উঠছে না, তখন ধর্মকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চাইছে। তৃণমূলের বক্তব্য, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে নাগরিকত্ব প্রদানের ইস্যুকে সামনে রেখে মতুয়াদের ভোটব্যাঙ্ক আদায় করেছিল বিজেপি। কিন্তু তারপর থেকে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগেও বিজেপি টের পেয়ে গিয়েছে তাদের রাজনৈতিক জমি মোটেও শক্তিশালী নয়। তাই এমতাবস্থায় রামকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবার চেষ্টা করছে। এপ্রসঙ্গে তৃণমূলের স্পষ্ট বক্তব্য, রাজনীতির ময়দানে লড়াই হোক কিন্তু ধর্মকে হাতিয়ার করে নয়। বিজেপি ধর্মের নামে রাজনীতি করছে। এর যোগ্য জবাব এবার দেবেন মানুষ।