Independence Day 2022 গান্ধীজি বলতেন, এটি তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি,স্বাধীনতার ইতিহাসে সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানের অবদান ভোলার নয়

0
1044

দেশের সময়: সালটা ১৯২৫। সোদপুর স্টেশনের পশ্চিম দিকে প্রায় ১৭ বিঘা জমির উপর গড়ে ওঠে একটি স্বদেশি প্রতিষ্ঠান। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শকে অবলম্বন করে এবং স্বদেশী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্নেহধন্য ছাত্র ছিলেন এই সতীশচন্দ্র। তাঁর উদ্ভাবনী কর্মদক্ষতা ও অসাধারণ প্রতিভা দেখে বেঙ্গল কেমিক্যাল কোম্পানিতে চাকরি দেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়।

১৯২৭ সালের ২ জানুয়ারি খোদ মহাত্মা গান্ধী উদ্বোধন করেন সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানের। আর এই প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান হন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। খাদি দ্রব্যের উৎপাদনই ছিল এই প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক লক্ষ্য। সুলেখা কালি, চরকা, ধান ভাঙার ঢেঁকি, তেল পেষাইয়ের ধানি, তালের গুড়, হাতে তৈরি কাগজ, দুগ্ধজাত সামগ্রী, সাবান, রং, দেশলাই, উন্নত মৌমাছি পালন করে তা থেকে মধু নিষ্কাশন, পাট প্রক্রিয়াকরণ এসবই ছিল সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কাজ।

যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল গ্রামের স্বনির্ভরতা। তবে এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন বইও প্রকাশ করা হত এখান থেকে। লাইব্রেরি, গবেষণাগার এমনকী ছাপাখানাও ছিল এই প্রতিষ্ঠানের। সেখান থেকে প্রকাশ পেয়েছে গান্ধী রচনা অনুবাদমূলক গ্রন্থ, ধর্ম মূলক উন্নত জীবনধারা গঠনের সহায়ক বিভিন্ন বই। আশ্রমিক পরিবেশ, সত্য নিষ্ঠ জীবনধারা প্রণালী ও গঠন মূলক কর্মকুশলতার বিকাশ ছিল এই আশ্রমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যা বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর।

এই প্রতিষ্ঠানকে যে বিশেষ মর্যাদা, গুরুত্ব ও ভালবাসার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করে গিয়েছেন, তার উল্লেখ পাওয়া যায় জাতির জনকের পাঁচশোরও বেশি চিঠি ও বিভিন্ন রচনায়। সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভা দেবী এবং সতীশ দাশগুপ্তের ভাই ক্ষিতিশ দাশগুপ্তের উপর অগাধ নির্ভরতা ও আস্থা ছিল গান্ধীজির। তাঁর লেখা চিঠিতে এসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। গান্ধীজির প্রার্থনা সভার প্রথম অডিও রেকর্ডিং করা হয় সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানে। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল তাঁর। গান্ধীজি বলতেন, এটি আমার দ্বিতীয় বাড়ি।

এককথায় অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব ভারতের সঙ্গে গান্ধীজির অন্যতম নিবিড় যোগসূত্র ছিল সোদপুরের এই স্বদেশী প্রতিষ্ঠান। আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক ড. শেখর শেঠ বলছেন, ১৯২৭ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট পর্যন্ত গান্ধীজি বিভিন্ন সময়ে সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানে এসেছেন। এমনকী পাঁচ থেকে সাত সপ্তাহ পর্যন্ত থেকেছেন। একাধিক উল্লেখযোগ্য কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। মহাত্মা গান্ধী এই প্রতিষ্ঠানে থাকাকালীন অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভা ও আলোচনা চক্র অনুষ্ঠিত হত। দেশের বহু বিশিষ্ট মানুষ আসতেন।

তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎ বসু, মতিলাল নেহেরু, জহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সরোজিনী নাইডু, বাদশা খান বা খান আব্দুল গফ্ফর খান, ড. আবুল কালাম আজাদ, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, ড. বিধানচন্দ্র রায়, সৈয়দ সুরাবর্দী, ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, রামকৃষ্ণ আজাদ, জি ডি বিড়লা প্রমুখ। ভারতের ও সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্পূর্ণ অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠান।

১৯৩৯ সালে ২৭-২৯ এপ্রিল তিন দিন ত্রিপুরী কংগ্রেসের পরবর্তী কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের জন্য কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু ও মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে জহরলাল নেহেরুর উপস্থিতিতে ঐতিহাসিক বৈঠক হয়েছিল সোদপুর খাদি আশ্রমে। গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্র দফায় দফায় বৈঠক করেও সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হন। এর পর সুভাষচন্দ্র সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। ভারতের ইতিহাসে এটি যুগান্তকারী মুহূর্ত। সুভাষচন্দ্রর কংগ্রেস ছাড়ার সিদ্ধান্তই ছিল ভবিষ্যতে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের সূত্রপাত।

সেই হিসেবে সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠান এক বিশাল ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের নীরব সাক্ষী। ১৯৪৫সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয় সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গনে। সেখানে গান্ধীজি গঠনমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার সময়ে এই ভবন থেকেই তিনি নোয়াখালি যাত্রা করেন এবং দীর্ঘ যাত্রার শেষে ফের এখানেই ফিরে আসেন। দেশভাগের প্রাক্কালে এই ভবনে যুক্তবঙ্গ প্রস্তাব নিয়ে গান্ধীজির সঙ্গে বৈঠক করেন শরৎচন্দ্র বসু।

১৯৪৭ সালের ১৩ মে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও গান্ধীজির সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানেই এক ঐতিহাসিক বৈঠক হয়। ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট গান্ধীজি এই ভবন থেকেই বেলেঘাটায় হায়দারি ভবনে যান। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠানের অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গান্ধীজির অহিংস সংগ্রামের একটি স্মরণীয় স্থান হিসেবে ২০১৪ সালে ইউনেস্কো জায়গাটিকে হেরিটেজ প্রাথমিক তালিকাভুক্ত করেছে। এটি শুধু সোদপুরের জন্য নয়, গোটা বাংলার কাছেও গর্বের।

Previous articleDesher Samay E paper দেশের সময় ই পেপার
Next articleMonsoon : দিনভর বৃষ্টিতে ভিজছে বাংলা !কী জানাচ্ছে হাওয়া অফিস

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here