দেশের সময়: হলুদ, তবে হলদে নয়। নীল এবং কালো। শুনতে অবাক লাগছে? মনে হচ্ছে সে আবার কেমন? হ্যাঁ, বিজ্ঞানীদের হাত ধরে হলুদের নয়া প্রজাতি এবার বাংলায়। শুধু নতুন রূপে নয়, গুণেও রীতিমতো টেক্কা দিচ্ছে তারা। যাঁদের এতদিন ধারণা ছিল যে, হলুদ শুধুমাত্র হলুদ রঙেরই হয়, তাঁরা এই নীল-হলুদ আর কালো-হলুদের ছবি দেখে যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। ইতিমধ্যেই নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে হলুদের পরিবারের এই নয়া অতিথিদের ছবি। ঝড়ের গতিতে তা ভাইরালও হয়েছে। প্রত্যেকেরই মনে অসম্ভব কৌতূহল, কেন এই রং পরিবর্তন হলুদের? কেমন খেতে হবে এই হলুদ? রান্নাতে কি ব্যবহার করা যাবে? বিশেষ কী গুণ রয়েছে অচেনা এই হলুদের। আমজনতার প্রশ্নের উত্তর দিতে চলছে বিস্তর গবেষণা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কালো হলুদ বা ব্ল্যাক টারমারিক জিনজিবারেসি গোত্রের এক ধরনের কন্দ জাতীয় গাছ। সাধারণ হলুদের তুলনায় এই গাছের পাতা ও কন্দের রং একটু অন্যরকম হয়। কালো হলুদের প্রধান রাসায়নিক উপাদান হল উদ্বায়ী তেল। এই তেলের মধ্যে প্রায় ৩০টি উপাদান চিহ্নিত করা গিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম ক্যাম্ফর, আর টারমেরন, জেড অসিমেন, আর কারকিউমিন, সিনিওল, ইলেমেন, বোরনেওল, বর্ণাইল অ্যাসিটেট প্রভৃতি। গবেষকদের দাবি, কালো হলুদের নির্যাস ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে।
কালো হলুদে প্রচুর পরিমাণে কারকিউমিন ও পলিফেনল থাকায় এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কার্যকর। তাছাড়া কালো হলুদে থাকা উদ্বায়ী তেল বি-সাবটাইলিস নামে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে শরীরকে। ফলে এটি জীবাণুনাশক হিসেবেও কাজ করে থাকে। মাংসপেশির সংকোচন প্রতিরোধেও কালো হলুদের বিশেষ গুণ রয়েছে। শুধু তাই নয়, কালো হলুদ স্নায়ু উদ্দীপক ও অনিদ্রা দূর করতেও সাহায্য করে। গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, কারকিউমিন থাকায় কালো হলুদের নির্যাস গ্যাস্ট্রিক আলসার প্রতিরোধেও অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ক্যান্সার রুখে দেয়। কালো হলুদের নির্যাস প্রদাহ দূর করে। এছাড়াও শ্বাসকষ্ট, পাইলস, ঘা, দাঁতে ব্যথা, জ্বর, আমাশয় ও খিঁচুনি প্রতিরোধে সাহায্য করে। আন্ত্রিকের সমস্যা দূর করতেও এর জুড়ি মেলা ভার।
প্রতিটি পরিবারে রান্নাঘরে হলুদ একটি জরুরি উপাদান। তবে হলুদ শুধু রান্নার কাজেই ব্যবহৃত হয় না। এর অসম্ভব ভেষজ গুণও রয়েছে। তা কমবেশি সকলেরই জানা। কিন্তু কালো ও নীল রঙের হলুদের ছবি প্রকাশ্যে আসতেই হইচই পড়ে গিয়েছে। জানা গিয়েছে, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশে এ ধরনের হলুদ বেশি দেখা যায়। এখন বাংলাতেও চাষ হচ্ছে।
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ফলানো হয়েছে নীল ও কালো হলুদ। এগুলি হলুদের খুবই বিরল প্রজাতি। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-গবেষক ডঃ দীপক ঘোষ বলছেন, নীল বা কালো হলুদ রান্নায় ব্যবহার করার জন্য নয়। এগুলির নির্যাসে রয়েছে অসম্ভব রকমের ভেষজ গুণ। ফলে ওষুধ তৈরিতেও হলুদের এই নয়া অতিথিদের কদর।
তবে শুধু হলুদ নয়, হলুদ আর গোলমরিচের যুগলবন্দিতে ম্যাজিক তৈরি হতে পারে বলে দাবি গবেষকদের। যা হাজারো অসুখ-বিসুখ থেকে দূরে রাখে শরীরকে। কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। হলুদকে বলা হয় মশলার রানি। অনেকে আবার বলে থাকেন অলৌকিক ভেষজ। প্রাচীনকাল থেকেই এর ব্যবহার হয়ে আসছে। আমাদের কাছে অতি পরিচিত। হলুদ না দিলে যে কোনও রান্নাই যেন পানসে। তবে গুঁড়ো নয়, গোটা হলুদ খান— এমনটাই পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। একইসঙ্গে তাঁদের সুপারিশ, শুধু হলুদ নয়, সঙ্গে যোগ করুন গোলমরিচ। এই জোড়া ফলাতেই ঘায়েল হবে মারাত্মক রোগব্যাধি। হাতেনাতে মিলবে ফল।
কিন্তু কেন?
আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঁচা হলুদে থাকে কারকিউমিন। এই উপাদানটি রক্তে মিশে গিয়ে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কিন্তু হলুদে থাকা কারকিউমিনকে শরীর পুরোপুরি গ্রহণ করতে অক্ষম। এখানেই দরকার গোলমরিচের। কারণ, গোলমরিচে থাকে পাইপারিন। এটি এক ধরনের পলিফেনল। যা হলুদের সঙ্গে মিশে গেলে শরীর পুরোমাত্রায় কারকিউমিন শুষে নিতে পারে।
কতটা পরিমাণে মেশাতে হবে এই উপাদান দু’টি? আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা বলছেন, ২ গ্রাম হলুদের সঙ্গে ২০ মিলিগ্রাম গোলমরিচের গুঁড়ো মেশালেই যথেষ্ট। এর ফলে শরীর ও অন্ত্রের গ্রহণ ক্ষমতা দু’হাজার গুণ বেড়ে যায়।
তবে গুঁড়ো হলুদ থেকে সাবধান থাকতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, মাছে ফর্মালিন, সব্জিতে রঙের মতোই গুঁড়ো হলুদে অনেক ক্ষেত্রেই মিশছে চক, রং থেকে রাসায়নিক।
ফলে তার মধ্যে কতটা আসল হলুদ থাকছে তা নিয়ে রয়ে যাচ্ছে সন্দেহ। ক্রমাগত এ ধরনের হলুদ খেতে থাকলে রক্তাল্পতা থেকে মহিলাদের বন্ধ্যাত্ব, পক্ষাঘাত থেকে নার্ভ টক্সিসিটি হতে পারে বলে সতর্ক করছেন চিকিৎসকরা। তাহলে? হলুদ ছাড়া রান্না? না, গুঁড়ো বর্জন করে কাঁচা বা গোটা হলুদেই ফিরতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, বাজার থেকে গোটা হলুদ কিনে নিয়ে এসে তা ভালোভাবে ধুয়ে বেটে খান। অনেক ভালো ফল মিলবে।
গবেষকরা বলছেন, হলুদে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে ফাইবার, পটাশিয়াম, ভিটামিন বি-৬, ম্যাগনেশিয়াম ও ভিটামিন সি। হলুদে থাকা কারকিউমিনের অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে খাদ্যনালীকে রক্ষা করে। তাছাড়া ট্রমাটিক ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে অর্থাৎ খারাপ বা ভয়ের স্মৃতি কমাতে সাহায্য করে হলুদে থাকা কারকিউমিন। একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে, রোজ কাঁচা হলুদ খেলে প্রায় ৫৬ রকম ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়।