মরু রাজ্য রাজস্থানে ভুতুড়ে জায়গার অভাব নেই। এখানকার রহস্যময় প্রাচীন দুর্গগুলির সঙ্গে মিশে আছে বহু অলৌকিক কাহিনি। আবার এই একুশ শতকেও আরাবল্লীর আনাচ কানাচে কান পাতলে শোনা যাবে বহু অতিপ্রাকৃতিক গল্প।
রাজপুতানার তেমনই একটি জায়গা হল কুলধারা। এক সময় থরের বুকে এই জায়গায় ছিল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। গত প্রায় ৩০০ বছর ধরে যা জনশূন্য। রাজস্থানবাসীর দাবি, রাত হলেই অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়ায় ওই গ্রামে!
জয়সলমেরের ‘সোনার কেল্লা’ থেকে কুলধারার দূরত্ব মেরে কেটে ১৮ কিলোমিটার। লোকমুখ শোনা যায়, একটা সময় পালীবাল ব্রাহ্মণদের বাস ছিল ওই গ্রামে। এহেন জনবহুল গ্রাম কী ভাবে লোকশূন্য হল? নেপথ্যে রয়েছে এক রোমাঞ্চকর কাহিনি।
তবে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে কোনো এক অজানা কারণে পরিত্যক্ত হয়। তবে স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে, এই গ্রামের ধ্বংসের কারণ ছিলেন তৎকালীন জয়সলমের রাজ্যের মন্ত্রী সালিম সিং।
গ্রামবাসীদের প্রতি তিনি কঠোর ও নৃশংস আচরণ করতেন। কুলধারা গ্রাম প্রধানের মেয়ের উপর তাঁর কুনজর পড়েছিল এবং মেয়েটিকে তাঁর হাতে তুলে দিতে বলেন। না দিলে বাড়তি করের বোঝা চাপানো হবে বলে হুমকিও দেওয়া হয়। তাই রাতারাতি ৮৪টি গ্রামের লোক যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়। যাওয়ার সময় ব্রাহ্মণরা অভিশাপ দিয়ে গেলেন, আর কোনও দিন এই গ্রামে মানুষের বসতি হবে না। সেই থেকে বিগত প্রায় তিনশো বছর ধরে জনশূন্য এই অভিশপ্ত গ্রাম। যারা গ্রামে পুনরায় জনবসতি করার চেষ্টা করেছিল তারা অলৌকিক কার্যকলাপের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল এবং তাই গ্রামটি জনবসতিহীন থেকে যায়।
অনেকে আবার সালিম ও গ্রামপ্রধানের মেয়ের কাহিনিতে প্রেমের অনুষঙ্গও খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের দাবি, মোড়লের মেয়ের প্রেমে পড়েন সালিম। তাঁকে বিয়েও করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি গ্রামবাসীরা। তাই এলাকা ছাড়ার আগে পরিবারের সম্মানরক্ষায় ওই মেয়েটিকে খুন করেন তাঁরা। সেই থেকে ওই মেয়েটিক অতৃপ্ত আত্মা গ্রামটিতে ঘুরে বেড়ায় বলে কাহিনি প্রচলিত রয়েছে।
২০১৩ সালে দিল্লির প্যারানরম্যাল সোসাইটির একটি দল এই গ্রামে এক রাত কাটিয়েছিল। তাঁদের একাধিক ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে বলেও দাবি করেছিলেন ওই দলের সদস্যরা। আর এই সব ঘটনা মিলিয়েই পাকাপাকিভাবে অভিশপ্ত গ্রামের তকমা লেগে গিয়েছে কুলধারা গ্রামের গায়ে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কিছু বাড়ি বা হাবেলী এখনও অক্ষত রয়েছে। গ্রামের মাঝখানে মন্দিরও অটুট আছে। বিস্ময়ের ব্যাপার যে এদের দেওয়ালের শিল্পকর্ম এত বছর পরেও একদা বিত্তশালী গ্রামের ঐতিহ্য বহন করছে।
আজ আমি আমার অভিজ্ঞতার এক রোমাঞ্চকর কাহিনি শোনাবো। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে ভালো ভাবে জায়গাটি সম্বন্ধে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি। কুলধারা সমন্ধে প্রচলিত কিংবদন্তি গুলো পড়ে খুবই আগ্রহ বোধ করছিলাম। জয়সালমের থেকে জীপে করে বিকেল বেলা আমরা কুলধারা গ্রামের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এসে পৌঁছলাম। গাইড বারবার বলে দিলেন ওনার সঙ্গেই যেন থাকি, কেউ যেন দলছুট না হয়ে পড়ি। চারিদিকে ঝকঝকে রোদ, ভূতের গল্পের কথা ভুলেই গেছি।
ফটো তোলার ঝোঁকে আমি একটু দূরে চলে এসেছি। সামনে একটা হাবেলী দেখে ভাবলাম ভেতর থেকে বাইরের ধ্বংসস্তূপের ভালো ফ্রেম পাওয়া যাবে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ঘরে ঢুকে বাইরের বিস্তীর্ণ ধ্বংসস্তূপ অবাক হয়ে দেখছি। বাড়ির ছাদ আছে কিন্তু জানালাগুলো ফাঁকা। আমি যখন ঘরে ঢুকি তখন বাইরে আশেপাশে লোকজন ছিল। তবে ঘরটা ফাঁকা আর বেশ অন্ধকার। জানালার ফ্রেমে নানাভাবে ছবি তুলছি। হয়তো একটু বেশি সময় ধরে ফটো তুলেছি। হঠাৎ মনে হল আমার পিছনে ঘরের কোণে কেউ বসে আছে।
কিন্তু আমি যখন ঘরে ঢুকি তখন কেউ ছিল ন। কেউ এলেও সে কোণে বসে আছে কেন? সেই মুহূর্তটা আমি জীবনে কখনো ভুলব না। শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত অনুভব করলাম। এটাকেই বোধ হয় প্যানিক অ্যাটাক বলে। ছোটবেলা থেকে যত ভূতের গল্প পড়েছি সব মনে পড়ে গেল। বুঝলাম আমি নড়তে পারছি না। কিভাবে যে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম জানি না। বেলা পড়ে আসছে তাই আশেপাশে কোন পর্যটক নেই। দূরে টুরিস্ট গাড়ি গুলো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেদিকে দৌড়ে গেলাম।
আজকাল তো আর কেউ ভূত বিশ্বাস করে না। কিন্তু সেদিন কী হয়েছিল তার কোনো উত্তর আমার জানা নেই। হয়তো লোকটা পর্যটক, ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিল। এভাবে ভাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেদিনের আতঙ্ক আজও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। দেওয়ালে মানুষের ছায়ার ছবি যে গুলো আমি তুলেছি, বাড়ি ফিরে যখন ফটো গুলো দেখছি তখন আলো আঁধারিতে বসে থাকা মানুষের অবয়ব আর ফটো গুলোর মধ্যে কেমন যেন এক রহস্যময় মিল খুঁজে পেলাম।
পুজোর সময় যারা রাজস্থান যাচ্ছেন অবশ্যই কুলধারা ঘুরে আসুন। কোনো রহস্য রোমাঞ্চ হয়তো আপনার জন্যও অপেক্ষা করছে।
ঐতিহাসিকদের দাবি, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কুলধারায় জনবসতি গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ আমলে ১৮১৫-তে তা জনশূন্য হয়ে যায়। তবে ১৮৯৯-তে লক্ষ্মী চন্দের লেখা ‘তারিখ-ই-জয়সলমের’-এ কুলধারার বহু তথ্য পাওয়া গিয়েছে। তবে কী ভাবে এই গ্রাম জনশূন্য হয়েছিল, তার সুস্পষ্ট কোনও নথি পাওয়া যায়নি।
ছবি ~ শম্পাগুহ মজুমদার