ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।
“বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়।” এমনই মুখ দেখেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। রূপসী বাংলায়। আজও যখন শিবরাত্রিতে ফাল্গুনের অখ্যাত-অন্তেবাসী ফুল বাংলার মাঠেমাঠে অজস্র ঘুঙুরের মতো ফুটে ওঠে, মনে হয় আবারও জীবন্ত হয়ে উঠবে সাপে কাটা লক্ষ্মীন্দর। মর্ত্যলোক থেকে আসবে এক বিধবা নর্তকী বেহুলা। তার পায়ে পায়ে ঘুঙুর হয়ে বাঁধা পড়বে বাংলার ভাঁটফুল। ফুলের গয়নায় বেহুলা ্ আমাদের মনোলোককে কল্পিত করবে। মঙ্গলকবিরা কল্পনা করবেন — ভাঁটফুল মানেই বেহুলার সতীত্বধর্মের প্রতীক। ভাটফুল মানেই বাংলার এক অন্তর্লীন ভাবজগত। আজও ফুটেছে বসন্তের ভাঁটফুল। আজও বাংলার সতী-সাবিত্রী পুণ্যতোয়া রমণী বেহুলা। বাংলার টিভি সিরিয়ালে যে অজস্র মিথ্যা পরকীয়া প্রেমের নিত্য আমদানি হয়, রোজ বিদেশি প্রভাবকে মরমি করে তোলার চেষ্টা হয়, তা ঝেঁটিয়ে বিদায় করার মতো কৌলিন্য অর্জন করতে পারে নি বাংলার ভাঁটফুল, বাংলার পল্লী-প্রকৃতি। কারণ ভাঁটফুল এবং তার কৃষ্টি দেখবার মানুষই নেই!
এই ভাঁটফুলের নামই ঘেঁটুফুল। এই ফুল দিয়েই পুজো হয় ঘন্টাকর্ণ নামে বাংলার এক লৌকিক দেবতা। ফাল্গুন মাসে যে বরবধূর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে, অথবা আসছে বৈশাখে যে যুবক-যুবতীর বিবাহ পাকা হয়ে আছে, প্রাক-বিবাহ পর্বে তাদের যাবতীয় চর্মরোগ নির্মূল করে তোলার জন্য অত্যাবশ্যক এই ভেষজ ঘেঁটুফুল এবং তার পাতা। এই ফুলেরই অধিষ্ঠানকারী দেবতা ঘেঁটুঠাকুর।
বাংলার এক অবলুপ্তপ্রায় শিশু-সংস্কৃতি হচ্ছে ঘেঁটুপুজোর ছড়া। আজ কিন্তু বাংলার গ্রামে-শহরে, পাড়া-মহল্লায় ঘুরে বেড়িয়ে এই কৃষিকৃষ্টি, এই লোকসংস্কৃতির খোঁজ পাওয়া নিতান্তই দুঃসাধ্য। তবুও যেসব জায়গায় আজও টিকে আছে এই শিকড়-সংস্কৃতি, আজই তাঁরই খোঁজ নেবো৷
বর্ধমানের রায়না থানা এলাকা থেকে সোৎসাহে ঘেঁটুঠাকুরের পূজার সংবাদ পাঠিয়েছেন শিক্ষক প্রবীর কুমার দাঁ। আমার আরও বন্ধু-বান্ধব পাঠিয়েছেন তাদের এলাকায় অনুষ্ঠিত এই লোকসংস্কৃতির চিত্র। খড়দহের কর্ণমাধবপুর গ্রামের বালক-বালিকারা আজও ফাল্গুন মাসের সন্ধ্যায় কলার দেল বা পাল্কি নিয়ে ঘেঁটুঠাকুরের গান গেয়ে বেড়ায় বাড়ি বাড়ি। গৃহস্থ থালা ভরে চাল-আলু ও টাকা দিয়ে তাদের আবদার মেটায়। ফাল্গুন সংক্রান্তির দিন তারা ঘেঁটু ঠাকুরের বার্ষিক পূজা করে। এই লৌকিক দেবতা ভন্টাকী বা ভাঁট/ঘেঁটু গাছের অধিষ্ঠাতা। তিনি সূর্য ও ধর্মঠাকুরের লৌকিক রূপ। তিনি কুষ্ঠ ও চর্মরোগের নিরাময়কারী দেবতা। বসন্ত কালে খোসপাঁচড়া, ছোঁয়াচে চর্মরোগের হাত থেকে রেহাই পেতে গ্রাম বাংলার লোক-সাধারণ পরপর কয়েকদিন সকালে কচি ঘেঁটু পাতার তিতো রস সেবন করেন। পাতা বেটে তা হলুদের সঙ্গে মিলিয়ে গায়ে মাখেন তারা। এতে শরীরের যাবতীয় চর্মরোগ দূরীভূত হয়। একদা এটাই ছিল বঙ্গদেশের এক অবর্থ্য লোকৌষধ।
ফাল্গুন সংক্রান্তিতে ঘেঁটু বা ঘন্টাকর্ণ নামক দেবতার পূজানুষ্ঠান হয় বেশ জাঁকজমক করেই। দিনের বেলায় গ্রাম্য পথের ধারে অথবা জলাশয়ের পাড়ে ভাঙ্গা হাড়ি উল্টে তার উপর গোবরের মণ্ড দিয়ে তৈরি হয় দেবতার মুখ। গোবরের মধ্যে কড়ির চোখ আর সিঁদুরের টিপ দেওয়া; গায়ে জড়ানো হলুদ-ছোপা এক টুকরো কাপড়। অনুষ্ঠান এত আন্তরিক হলে কী হবে! পূজার আয়োজন কিন্তু একান্তই সাধারণ। ঘেঁটুপূজায় লাগে দূর্বাঘাস, ভাঁটফুল। পূজার নৈবেদ্য বলতে সামান্য বাতাসা, কদমা আর নকুলদানা। পূজার শেষে শিশুর দল কলার মান্দাস বা খোল দিয়ে তৈরি করে নেয় ডুলি-পাল্কি। তা কাঁধে চাপিয়ে বাড়ি বাড়ি ছড়া কেটে বেড়ায় শিশুর দল। সংগ্রহ করে চালডাল, সব্জি ইত্যাদি। সংক্রান্তির দিন রাতে খিঁচুড়ি রেধে একসঙ্গে ভোজন হবে। আপনি কি শুনবেন ওদের ছড়া-গান?
“ঘেঁটু যায় ঘেঁটু যায় গৃহস্থের বাড়ি
এক কাঠা চাল দাও কুমড়োর বড়ি।
যে দেবে থালা থালা তার হবে কোঠা-বালা
যে দেবে মুঠো মুঠো তার হবে হাত ঠুটোঁ।
যে দেবে এক পলা তেল তার হবে সোনার দেল।
যে দেবে শুধু বকুনি ঘাঁটু দেবে খোসচুলকানি।”
হারিয়ে যাচ্ছে এই সংস্কৃতি। ছোট্ট বাচ্চাদের কলার দেলে চেপে ঘেঁটু ঠাকুরের যাত্রাপথ আমাকে লোকসংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া অধ্যায় আবার স্মরণ করিয়ে দিল।