তিন ঘণ্টারও কম সময়ে ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল দেশের তিন প্রান্ত। দিল্লি, বিহারের পর কম্পন অনুভূত হল ওড়িশার পুরী জেলার বিস্তীর্ণ অংশে। রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ৪.৭। যদিও এখনও পর্যন্ত সে রাজ্য থেকে কোনও প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতির খবর মেলেনি।
দেশের সময় : কেউ বেরিয়েছিলেন প্রাতঃভ্রমণে। কেউ বা গন্তব্যের উদ্দেশে। আচমকা কয়েক পলকের জন্য তীব্র আওয়াজে চমকে উঠলেন সকলে।
সোমবার সাত সকালে ভূমিকম্পের জেরে রাজধানী দিল্লিতে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ ভেবেছিলেন, মাটির তলা দিয়ে বোধহয় সজোরে ট্রেন ছুটল! দিল্লি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন আঁতকে উঠেছেন এই ভেবে যে ফের বুঝি ট্রেন দুর্ঘটনা হল! রেলের কাউন্টার থেকে ঘরবাড়ি, সবই যেন নড়ছিল। সামনে এসেছে কম্পনের সেই ভয়াবহ ভিডিও।
https://x.com/calm_banker/status/1891298037135286440?t=xbobrcpfq5h67QgaJ631Ng&s=19
দিল্লি স্টেশনের এক চা বিক্রেতা এদিন সকালে কম্পনের পর সংবাদ সংস্থাকে বলেন,” একটা বিরাট ঝাঁকুনি। দোকানের সব জিনিস নড়ছিল। মনে হল, যেন আবার ট্রেন দুর্ঘটনা। পরে শুনি, ওটা ভূমিকম্প ছিল!”
এক প্রাতঃভ্রমণকারীর কথায়, “হঠাৎ তীব্র আওয়াজ। মনে হল মাটির তলা দিয়ে সজোরে ট্রেন ছুটছে। সামনে তাকিয়ে দেখি, দোতলা বাড়িটা দুলে উঠল!” আতঙ্কে অনেকে চিৎকারও করতে থাকেন। ভূমিকম্পের আতঙ্ক এমনভাবে ছড়িয়েছে যে অনেকেই ঘটনার দু ঘণ্টা পরেও ফাঁকে মাঠে বসে রয়েছেন। বাড়ি যাওয়ার সাহস দেখাচ্ছেন না, যদি আবার ভূমিকম্প হয়!
রিখটার স্কেলে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প সাড়া ফেলে দিয়েছে দিল্লিতে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সমাজমাধ্যমে এই ভূমিকম্প নিয়ে পোস্ট করেছেন। বাসিন্দাদের সতর্ক থাকার অনুরোধ করেছেন। সোমবার ভোরে কম্পন দেখে দিল্লির মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন। এখনও আতঙ্ক কাটেনি অনেকের। এই ভূমিকম্পের পর দিল্লির অনেকে বলছেন, তাঁরা কম্পনের সময়ে মাটির নীচ থেকে ‘গর্জনের মতো শব্দ’ পেয়েছেন। যা আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু কেন এই শব্দ? ভূমিকম্পে শব্দ হওয়া কি স্বাভাবিক? কী বলছে বিজ্ঞান?
ভূমিকম্পের মাত্রা কম হলেও কেন দিল্লিতে জোরালো কম্পন?
সোমবারের ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল দিল্লিতেই। দক্ষিণ দিল্লির ধৌলাকুঁয়ায় দুর্গাবাই দেশমুখ কলেজ অফ স্পেশ্যাল এডুকেশনের জমির ঠিক নীচে ভূমিকম্প হয়েছে। মাটি থেকে তার গভীরতা মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ভূমিকম্পের গভীরতা কম থাকলে অনেক ক্ষেত্রে শব্দ হতে পারে।
আমেরিকার জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) অনুযায়ী, ভূমিকম্পের সময়ে ভূমি কাঁপে। এর ফলে ছোট ছোট ভূকম্পীয় তরঙ্গ তৈরি হয়। এগুলি মাটির উপরে হাওয়ার সংস্পর্শে এলে শব্দতরঙ্গ তৈরি করে। ভূমিকম্পের ফলে উৎপন্ন প্রথম তরঙ্গের নাম পি-ওয়েভ। এগুলি শব্দতরঙ্গের মতোই। মাটির উপরেও সেই কম্পনের শব্দ শোনা যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ভূমিকম্পের কেন্দ্র যত বেশি অগভীর হবে, তার শক্তি মাটির উপরে ধাক্কা দেবে তত বেশি। উচ্চ কম্পাঙ্কের ভূকম্পীয় তরঙ্গ যদি মাটির নীচে তৈরি হয়, তবে তার শব্দ উপর থেকেও শোনা যেতে পারে। জমি শক্ত হলে গর্জন-শব্দ বেশি হতে পারে। দিল্লির ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে বলে মত অনেকের।
দিল্লির বাসিন্দারা অনেকেই মানতে পারছেন না, রিখটার স্কেলে সোমবারের ভূমিকম্পের মাত্রা মাত্র ৪। উৎসস্থল অগভীর হওয়ার কারণে মাত্র ৪ মাত্রাতেই এত কম্পন অনুভূত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভোর ৫টা ৩৬ মিনিটে বেশ কয়েক সেকেন্ড কম্পন স্থায়ী হয়।
দিল্লির ভূমিকম্পের ঘটনায় কেন এত জোরে কম্পন অনুভূত হলো?
এই প্রশ্নের জবাবে বেশ কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এই কারণগুলির মধ্যে অন্যতম
দিল্লির মধ্যে উৎসস্থল ।
ভূমিকম্পের উৎসস্থল শহরের মধ্যেই। ফলে এর ফলে তৈরি হওয়া তরঙ্গ খুব শক্তিশালী ভাবে অনুভূত হয়েছে। মাটির অগভীরে তা ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ খুব বেশি ছিল না।
কম্পনের উৎসস্থল খুব গভীরে নয়
এই কম্পনটির উৎসস্থল ভূপৃষ্ঠ থেকে অগভীরে। এর ফলে রিখটার স্কেলে মাত্রা ৪ থাকলেও কম্পন গভীর ভাবে অনুভূত হয়েছিল।
দিল্লি, নয়ডা, গাজিয়াবাদে একাধিক বহুতল রয়েছে। উচ্চতার কারণে এই বহুতল আবাসনগুলিতে কম্পন্ন অপেক্ষাকৃত বেশ অনুভূত হয়েছে।
দিল্লির কিছু এলাকায় নরম অ্যালুভিয়াল মাটি রয়েছে যা কম্পনের তরঙ্গ ছড়িয়ে দেয় এবং সেই কারণে আরও বেশি করে কম্পন অনুভূত হয়েছে।
কেন বারবার ভূমিকম্প দিল্লিতে?
ভূ-বৈজ্ঞানিকদের মতে, দিল্লির ভৌগলিক অবস্থান এমন এক জায়গায় যা মহেন্দ্রগড়-দেরাদুন চ্যুতিরেখার খুবই কাছাকাছি অবস্থিত। হিমালয়ান রেঞ্জের থেকেও এর দূরত্ব মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার। ইন্ডিয়ান ও ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে তৈরি হয়েছিল হিমালয় পর্বত। এই দুই পাতের মধ্যে সংঘর্ষ এখনও ঘটে চলেছে। ফলে প্রাই সেখানে কম্পন অনুভূত হয়।
ভূবিজ্ঞানী সুজীব কর বলেন, ‘দিল্লির ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ৩২ সেকেন্ড এবং তার উৎসস্থল ছিল দিল্লি শৈলশিরার উপরে। আর এই কারণের জন্য কম্পন এত তীব্র ভাবে অনুভূত হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, গত ২৩ জানুয়ারি দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় একই ভাবে প্রবল কম্পন অনুভূত হয়েছিল। সেই কম্পনের উৎসস্থল ছিল চিনের জিনজিয়াং প্রদেশে। তার দু’সপ্তাহ আগে ১১ জানুয়ারি দিল্লি ও তার লাগোয়া এলাকা আফগানিস্তানের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে।
উল্লেখ্য, সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দিল্লির ভূমিকম্পের আড়াই ঘণ্টার পরে কম্পন অনুভূত হয় বিহারের সিওয়ানে।
সোমবার সকাল ৮টা ২ মিনিটে সিওয়ানে ভূমিকম্প হয়। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি সূত্রে খবর, রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ছিল ৪। মাটির উপরিভাগ থেকে ১০ কিলোমিটার নীচে ছিল কম্পনের উৎসস্থল।
এদিন সকাল ৮টা ২ মিনিটে কম্পন অনুভূত হয় বিহারের সিওয়ান জেলার বিস্তীর্ণ অংশে। ভূমিকম্পের উৎসস্থল মাটি থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে বলে জানায় ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি। অবশ্য পুরীর ভূকম্পের উৎসস্থল কোথায়, তা এখনও জানা যায়নি। তবে হঠাৎ কম্পন অনুভূত হয়ে পড়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন স্থানীয় এবং পর্যটকেরা।
প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘‘দিল্লি এবং আশপাশের এলাকায় কম্পন অনুভূত হয়েছে। সকলের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা শান্ত থাকুন। ভূমিকম্প পরবর্তী কম্পন হতে পারে, তার জন্য সতর্ক থাকুন। পরিস্থিতির দিকে নজর রেখেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।’’ বাসিন্দারা অনেকেই সমাজমাধ্যমে অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, এই ধরনের কম্পন এর আগে কখনও অনুভব করেননি।