দুর্গাপূজা যত এগিয়ে আসছে, হাসিনাহীন বাংলাদেশে ততই চাপ বাড়ছে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর। এর আগেই কুলনা জেলায় মন্দির ভাঙচুর, দুর্গাপুজো কমিটিগুলির কাছে তোলা চেয়ে হুমকি চিঠি দেওয়ার মতো ঘটনা সামনে এসেছিল। এবার ‘দুর্গাপুজো সর্বজনীন নয়। বরং এমন দাবি করার অর্থ অন্য ধর্মকে অবমাননা করা।’ লিফলেট জারি করে বাংলাদেশ জুড়ে এমনই ফতোয়া জারি করল ইনসাফ কায়েমকারী ছাত্র-জনতা। সংস্থার আহ্বায়ক মুহম্মদ আরিফ আল খাবিরের নামে শনিবার একটি দু’পাতার লিফলেট সারাদেশে বিলি করা হয়েছে। তাতে দুর্গাপুজো করা নিয়ে ১৬ দফা ফতোয়া জারি করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থার তরফে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের অবসানের পর থেকেই সেদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। দুর্গাপুজো করার জন্য বিভিন্ন ক্লাবের কাছ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা করে চাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল একাংশ মানুষের বিরুদ্ধে। ঢাকার উত্তরাতেও দুর্গা পুজো করা নিয়ে আপত্তি তুলেছে এলাকার একাংশ মানুষ। তাঁরা জানিয়েছে, পার্কে পুজো করা যাবে, বাজানো যাবে না মাইক, কারণ, তাতে নমাজে সমস্যা হয়।
এবার ‘ইনসাফ কায়েমকারী ছাত্র-জনতা’ নামের সংস্থার তরফে জারি করা হল ১৬ দফা ফতোয়া। সেখানে পরিষ্কারভাবে লেখা হয়েছে, কোনও মন্দিরে দুর্গা পুজোকে সর্বজনীন উল্লেখ করে সাইন বোর্ড টাঙানো যাবে না। কারণ, ধর্ম যার যার, উৎসবও তার তার।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের হিন্দুদের ‘ভারতের দালালি’ বন্ধ করার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। এজন্য মন্দিরগুলিতে ভারত বিরোধী ব্যানার ও পুজোতে ভারতবিরোধী স্লোগান রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, হিন্দু মানেই ভারতের দালাল, বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এ অপবাদ ঘুচাতে হবে। যেহেতু ভারত বাংলাদেশের জাতীয় শত্রু, তাই বাংলাদেশের হিন্দু নাগরিকদেরও ভারত বিরোধিতায় সম্মতি দিতে হবে।
জারি করা ফতোয়ায় এও বলা হয়েছে, রাস্তা বন্ধ করে মণ্ডপ তৈরি করে যত্রতত্র পুজো করা চলবে না। পুজো করতে হবে মন্দিরের ভেতরেই। যত্রতত্র পুজোর ব্যানার লালানো যাবে না। বাজানা যাবে না মাইকও।
সংস্থার তরফে জারি করা লিফলেটে এও বলা হয়েছে, কোনও মন্দিরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংখ্যক মূর্তি বানানো বা ইচ্ছে মতো মূর্তির উচ্চতা বৃদ্ধি করা যাবে না। পুজোকে কেন্দ্র করে মন্দিরে খাওয়া যাবে না মদ।
এমনকী দুর্গাপুজোয় ছুটিরও বিরোধিতা করেছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি। লিফলেটে তাঁদের দাবি, জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশেরও কম হিন্দু ধর্মাবলম্বীর জন্য শতকরা ৯৮ ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে কাজ থেকে দূরে রেখে অর্থনীতির ক্ষতি করা চলবে না।
পুজো উপলক্ষে কোনওরকম চাঁদা আদায় করা যাবে না বলেও জানানো হয়েছে। কারণ, হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, মুসলমানদের জন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পুজোয় আর্থিক সহযোগিতা শরীয়তে নিষিদ্ধ।
৩ দিন পরেই মহালয়া। তারপরেই দুর্গাপুজো। এমন আবহে নয়া ফতোয়াকে ঘিরে বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে তীব্র আতঙ্কের পরিবেশ ছড়িয়েছে। তবে ফতোয়া জারি করা এই সংস্থাটির সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , ক্ষমতা গ্রহণের পর মহম্মদ ইউনুস অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি বারবার দাবি করেছেন, হিন্দুদের উপর হামলা কোনও ধর্মীয় কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণে হয়েছে। অধিকাংশ হিন্দু আওয়ামি লিগপন্থী হওয়ায় হামলার নিশানা হয়েছেন তাঁরা। কয়েকদিন আগেই আমেরিকায় বসে বাংলাদেশের বিদেশ উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, ‘হিন্দুরাও আমাদের নাগরিক’ বলে, তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার বার্তা দিয়েছিলেন। গত রবিবার, বাংলাদেশের পুলিশ দুর্গাপুজোয় নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, তার ফিরিস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু, মৌলবাদীদের এই প্রকাশ্য আস্ফালন বলে দিচ্ছে বাস্তব ছবিটা অনেকটাই আলাদা। উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশি হিন্দুদের। ইউনুসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস সত্ত্বেও আকাশে-বাতাসে রয়েছে চাপা উত্তেজনা।