দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ শীর্ষ আদালতের নির্দেশ ছিল, ডাক্তারেরা ১০ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টার মধ্যে কাজে যোগ দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করতে পারবে না রাজ্য। কিন্তু কর্মবিরতি এখনও চলছে জুনিয়র ডাক্তারদের। পাঁচ দফা দাবিতে অনড় তাঁরা। মঙ্গলবার ফের আরজি কর মামলার শুনানি রয়েছে শীর্ষ আদালতে। কাজে যোগ না দেওয়ার জন্য কি শীর্ষ আদালতে অস্বস্তিতে পড়তে হতে পারে তাঁদের? কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার সপক্ষে কী যুক্তি দেখানোর পরিকল্পনা তাঁদের?
আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের আবার ডাকা হল বৈঠকের জন্য। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়িতে সোমবার বিকাল ৫টায় তাঁদের ডাকা হয়েছে। এই মর্মে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ জুনিয়র ডাক্তারদের ইমেল করেছেন। শুনানির ২৪ ঘণ্টা আগে কী ভাবছেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারেরা?
সুপ্রিম কোর্টের আগের শুনানিতেই জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মন্তব্য করেছিল প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। ডাক্তারদের মনে আস্থা ফেরাতে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশনামাতেও সে কথা উল্লেখ করেছিল।
আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি তথা আরজি করের জুনিয়র ডাক্তার আরিফ আহমেদের কথায়, “সুপ্রিম কোর্টে মামলার শুনানি রয়েছে। তার জন্য আমাদের আইনজীবী থাকছেন ইন্দিরা জয়সিংহ। আমাদের কর্মবিরতির প্রসঙ্গ এবং তার সঙ্গে নির্যাতিতার বিচারের দাবি, হাসপাতালের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা-সহ অন্য দাবিগুলি তিনি একে একে তুলে ধরবেন। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, রাজ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলি দেখুক এবং আন্দোলনকারীরা কাজে যোগ দিক। আমরা দেখাতে চাইছি, সুপ্রিম কোর্ট যে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার কথা বলেছিল, সেটিও সরকার ঠিকঠাক ভাবে দেয়নি।”
মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে জুনিয়র ডাক্তারদের হয়ে সওয়াল করতে দেখা যাবে প্রবীণ আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহকে। অভিজ্ঞ আইনজীবীর উপরেই ভরসা রাখছেন আন্দোলনকারীরা। সুপ্রিম কোর্ট গত শুনানিতেই রাজ্য সরকারকে বলেছিল ডাক্তারদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য। আপাতত সেটিকেই ঢাল করে যুক্তি দেখাতে চাইছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরা সংক্রান্ত বিষয়ে শীর্ষ আদালতের নির্দেশ ছিল কি না, তা নিয়েও গত কয়েক দিনে বিস্তর চর্চা হয়েছে। তবে আদালতের নির্দেশনামার ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ, ডাক্তারেরা ১০ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টার মধ্যে কাজে যোগ দিলে, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও শৃঙ্খলাভঙ্গের পদক্ষেপ করতে পারবে না রাজ্য। ডাক্তারদের মনে আস্থা ফেরাতে রাজ্যকে এই নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। সঙ্গে আরও উল্লেখ ছিল, পরবর্তীতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত খামতির কোনও অভিযোগ এলে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ সুপার।
তবে এই ব্যবস্থাগুলি হয়ে যাওয়ার পরেও ডাক্তারেরা যদি কাজে যোগ না দেন, সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে পদক্ষেপ করা যেতে পারে। নির্দেশনামার ওই অনুচ্ছেদেই সুপ্রিম কোর্ট আরও জানিয়েছিল, সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দেওয়া রেসিডেন্ট ডাক্তারদের কাজ এবং সেটি থেকে তাঁরা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না এবং উল্লেখিত সময়ের মধ্যে তাঁদের কাজে যোগ দেওয়া উচিত।
আন্দোলনকারীদের কথায় , তাঁরা এখন অপেক্ষায় রয়েছেন মঙ্গলবার শীর্ষ আদালতে শুনানির দিকে। শীর্ষ আদালত থেকেই এই অচলাবস্থা কাটার বার্তা মিলবে বলে আশাবাদী তাঁরা।
এদিকে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনার জন্য সোমবার সরকার ফের প্রস্তাব দিয়েছে। মুখ্য সচিব মনোজ পন্থ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের জন্য এটা শেষ প্রস্তাব। তার পর জুনিয়র ডাক্তারদের অধিকাংশই মনে করছেন, আলোচনায় অংশ নিয়ে এদিনই কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। তাঁদের পাঁচ দফা দাবির মধ্যে সরকার অন্তত দুটি দাবি মেনে নিলে আর অচলাবস্থা জিইয়ে রাখা সঙ্গত হবে না।
জুনিয়র ডাক্তারদের পাঁচ দফা দাবির মধ্যে প্রথমটি হল, আরজি করের ঘটনার দ্রুত বিচার ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। তা ছাড়া তথ্য ও প্রমান লোপাট যারা করেছে তাদের কঠোরতম সাজা হোক।
আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, এখানে রাজ্য সরকারের এখন কিছু করার নেই। এ ব্যাপারে সিবিআই তদন্তের অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে।
বাকি চার দফা দাবি হল, সন্দীপ ঘোষকে সাসপেন্ড করতে হবে। স্বাস্থ্য সচিব, ডিরেক্টর হেল্থ সার্ভিসেস এবং ডিরেক্টর মেডিকেল এডুকেশন পদে এখন যাঁরা রয়েছেন তাঁদের সরাতে হবে। তিন, কলকাতা পুলিশের কমিশনারের পদ থেকে বিনীত গোয়েলকে ইস্তফা দিতে হবে। চার, সব মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল আর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। এবং সর্বোপরি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে ভয়মুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সুনিশ্চিত কায়েম করতে হবে।
জুনিয়র ডাক্তারদের অধিকাংশের মতে, বাকি চার দফা দাবির মধ্যে সরকার দুটি মেনে নিলেই কর্মবিরতি তুলে নেওয়া উচিত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এমনিতেই হাসপাতালে ভয়মুক্ত পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। তা ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা পরিকাঠামো বাড়ানোর ব্যাপারেও সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। সরকারকে মঙ্গলবার এ বিষয়ে স্ট্যাটাস রিপোর্ট পেশ করতে হবে সর্বোচ্চ আদালতে। এই দাবিগুলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনিতেই মেনে নিয়েছেন। শনিবার ধর্নামঞ্চে গিয়ে তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন সেটি। সেই সঙ্গে হাসপাতাল পরিচালন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে নেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন।
জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি ও আন্দোলনের মধ্যে এখন নানা মুনি। তাঁদের মতও নানা। এঁদের মধ্যে ডিএসও, এআইডিএসও, এসএফআই এমনকি মাওবাদীরাও রয়েছেন বলে খবর। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের অনেকের দাবি, হাতে গোণা কয়েকজন উগ্র বামপন্থী ছাড়া বেশিরভাগই কাজে ফিরতে চাইছেন। কারণ তাঁদের এর পরেও জেদাজেদি করলে সর্বোচ্চ আদালতও তা ভালভাবে নেবে না। তা ছাড়া সরকার যেহেতু সহানুভূতি দেখাচ্ছে এবং বারবার আলোচনার জন্য ডাকছে, তাতে এর পর কোনও আড়ষ্টতা দেখালে জনমতও বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে।
এখানে জানিয়ে রাখা ভাল, আরজি কর মামলা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে গত শুনানিতেই প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ১০ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টার মধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফিরতে হবে। কিন্তু তার পরেও কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। নির্ধারিত সেই সময়ের পর আরও পাঁচ দিন কেটে গেছে। মঙ্গলবার ফের সুপ্রিম কোর্টে মামলার শুনানি রয়েছে। জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে বড় অংশ মনে করছে, কর্মবিরতি সোমবার প্রত্যাহার না করলে মঙ্গলবার আদালতের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হবে। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশকে অবমাননা করা সঙ্গত কাজ হচ্ছে না।