Debarati mukhopadhyay: আগে নিজের মা’কে ভালবাসতে শিখি, তারপর তো অন্যের মা! দেবারতি মুখোপাধ্যায়

0
820

প্রথমেই একখানা নিরীহ প্রশ্ন করি। বাংলা ভাষা কবে পুরোপুরি শুদ্ধ ছিল?

কাঁচি, বাবা, লাশ,
কুর্নিশের মত তুর্কি শব্দই হোক বা আলমারি, আনারস, বালতি, সাবানের মত পর্তুগীজ শব্দ। শতাব্দীর পর
শতাব্দী ধরে বিদেশী অনুপ্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এই ‘তথাকথিত’ বিদেশী শব্দগুলোও কবেই ঢুকে পড়েছে
বাঙালি অন্দরমহলে। নুন-হলুদ মাখানো মাছ আর সর্ষের তেলের গন্ধমাখা সুখদুঃখের ভাতে কবে যেন তারা
মিলেমিশে হয়ে উঠেছে খাঁটি বাঙালি। এই একই কথা প্রযোজ্য আইন, চশমা, সর্দি, সব্জি, দোকান, পিঁয়াজ,
বালিশ, শিশির মত ফারসি শব্দগুলোর ক্ষেত্রেও।
তাহলে বেচারা ইংরেজি কী দোষ করল?

যারা নবীন প্রজন্মের কথায় কথায় ইংরেজির ফোয়ারা
ছোটানো দেখে, একটা বাক্যের মধ্যে বাংলা ইংরেজি মেশানো ‘বাংলিশ’ শুনে শাপশাপান্ত করেন ও বাংলা
ভাষার নিদারুণ ভবিষ্যৎ নিয়ে বিলাপ করেন, তারা কি নিজেরা উপরিউক্ত শব্দগুলো কথায় কথায় ব্যবহার
করেন না? নাকি স্কুল, ডায়েরি, অফিসের মত ‘বিলিতি’ শব্দগুলোও কথোপকথনে ব্যবহার করেন না?
আসল কারণ এই ‘ইংরেজি-আয়ন’ নয়। মূল কারণ অন্য এবং অনেক গভীরে প্রোথিত।

গত কয়েকদশকে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও বিশ্বায়নের প্রসারতায় ইংরেজি এতটাই আন্তর্জাতিক হয়ে
পড়েছে যে কমবেশি একঘরে হয়ে পড়েছে আঞ্চলিক ভাষাগুলো। কিন্তু তার মানেই কি তারা মৃতপ্রায় হয়ে
পড়বে? তবে তো যে দীর্ঘ দুশো বছর ব্রিটিশ সূর্য উড্ডীন ছিল প্রায় অর্ধেক বিশ্বে, সেই উপনিবেশ
দেশগুলোর সব ভাষারই এতদিনে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হত। হয়নি। কারণ সেই ভাষার মানুষরা তা হতে দেননি।
তাঁদের সদিচ্ছাই বাঁচিয়ে রেখেছিল ভাষাগুলোকে।
এখনকার প্রজন্ম ইংরেজি শিখুক, অবশ্যই ভাল করে শিখুক। কিন্তু একটা আজকের বাঙ্গালির
কাছে ইংরেজি শুধু একটি ভাষা নয়, শিক্ষার প্রতীক, আভিজাত্যের প্রতীক। তাই ক্লাস এইট নাইনে পাঠরত
পুত্র কিংবা কন্যা বাংলা গড়গড় করে পড়তে পর্যন্ত পারে না, তা বন্ধুমহলে গর্বিতমুখে ফলাও করে বলেন
খাঁটি বাঙালি বাবা মায়েরা। ফার্স্ট ল্যাঙ্গোয়েজ ইংরেজি, সেকেন্ড ল্যাঙ্গোয়েজ হিন্দি। বাংলা টিমটিম করে
পড়ে থাকছে একপাশে, অবহেলায়। যে জাতি নিজের মাতৃভাষাকে অবহেলা করে, তার অবনমন অবশ্যম্ভাবী।
তাই বোধ হয় নীরদ সি চৌধুরী বলেছিলেন, বাঙালি আত্মঘাতী জাতি।

দেখে কষ্ট হয়। দুঃখ হয়। জন্মের পর একটি শিশু সবচেয়ে আগে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে মাতৃভাষাকে,
কারণ সেই ভাষা সেই মাতৃগর্ভ থেকে শুনে আসছে। নিজের মা’কে আগে না ভালবাসলে সে অন্যের মা’কে
ভালবাসবে কী করে? ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক জগাখিচুড়ি প্রজন্মের, যারা কোনটাই ভালমত শিখছে না। দায়ী
কারা?

অবশ্যই আমরা।
যখন দেশের অন্য কোনো উত্তরভারতীয় রাজ্যে বেড়াতে যাই, আমরা খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে
হিন্দি বলি। আপনি বলবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক, ওটা তো হিন্দিভাষী শহর! কিন্তু কোনো হিন্দিভাষী কি
কলকাতায় এসে আমাদের বাংলায় জিজ্ঞাসা করেন যে “ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালটা কোনদিকে?” তারা কিন্তু
হিন্দিতেই জিজ্ঞাসা করেন, আর আমরাও খাস কলকাতার বুকে বসে তাঁদের হিন্দিতেই প্রত্যুত্তর করি।
রিকশাওয়ালা আদৌ অবাঙ্গালী কিনা তা না জেনেই বেমালুম হিন্দিতে তাকে আদেশ করি। বাসে
কনডাক্টরকে বলি, “এই ভাই! ইতনা জলদি কিউ? রোককে!”

এভাবেই দুই বাঙ্গালী হিন্দিতে বেমালুম কথা চালিয়ে যায়। জটায়ুর মত সোল্লাসে কেউ বলে ওঠে না,
আরে! আপনি বাঙ্গালী?

ইউরোপের একটা দেশে একবার বেশ কিছুদিন ছিলাম, সে দেশ মাত্র ৩৫ বর্গ কিলোমিটারের,
সাকুল্যে কুড়ি হাজার জনসংখ্যা, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম দেখে, তার মধ্যেও তাঁরা নিজেদের ভাষা,
নিজেদের সংস্কৃতি লুপ্ত হতে দেননি, বয়ে নিয়ে চলেছেন সযত্নে। কই তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো!
জার্মানি থেকে নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স থেকে ইটালি প্রতিটা দেশে সরকারি কাজ হয় নিজস্ব ভাষায়, কিছু
দেশে পড়তে গেলে পাশ করতে হয় আঞ্চলিক ভাষাতেও।
আর সেখানে আমরা কোটি কোটি বাঙ্গালী সযত্নে আমাদের ঐতিহ্যমন্ডিত ভাষাটাকে এগিয়ে দিচ্ছি
বিলুপ্তির পথে।

কর্মজীবনের শুরুতে চেন্নাইতে চাকরি করতাম, ওখানকার মানুষজনকে দেখতাম নিজেদের ভাষা,
নিজেদের সংস্কৃতি বজায় রাখতে তাঁরা কতটা উদগ্রীব, কতটা ভালবাসেন তাঁরা তাঁদের নিজস্ব কমিউনিটিকে।
নিজেদের সুবিধার্থে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম কাজ চালানোর মত ছোট ছোট তামিল কথা শিখতে। কিন্তু তাঁরা
কি তাই বলে ইংরেজিতে দুর্বল? মোটেই নয়।
আর বাঙ্গালী? বাঙ্গালী নিজেই নিজেকে নিয়ে খিল্লি করে, দুর্গাপুজো হয়ে যায় নবরাত্রি,
কালীপূজোর এখন বাঙ্গালী মেয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাসে ‘হ্যাপি দিওয়ালি”, রথের মেলায় বাঙ্গালী সবিস্ময়ে
লক্ষ্য করে রামনবমীর অস্ত্রমিছিল। এসব কিন্তু বছর পাঁচেক আগেও ছিল না। আমাদের মা- ঠাকুমারা মনে
পড়ে না কোনোদিনও ধনতেরস পালন করেছেন।
চীনের বাজার দখল করতে একদিন পশ্চিম দুনিয়া এভাবেই আফিম এনে নেশা ধরিয়েছিল চীনাদের।
চীন কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।

বাঙ্গালী কবে দাঁড়াবে? আদৌ কি দাঁড়াবে?
ইংরেজি চলুক। হিন্দি চলুক। বাংলায় বিদেশী শব্দও আসুক নতুন নতুন। কিন্তু আমাদের ভাষাটা
চলুক তরতরিয়ে। বাংলা বলা, বাংলা লেখা লজ্জা নয়, বাংলা হোক মায়ের বুকের গন্ধমাখা আদর! আমাদের
ভালবাসা! কলকাতার পাঁচতারা হোটেল, বিমানবন্দর বা শপিং মলগুলোয় গিয়ে মাথা উঁচু করে বাংলা বলুন।
দেখবেন সবার আড়ালে বুকটা ফুলে উঠবেই! মা যে!

Previous articleDesher Samay e Paper দেশের সময় ই পেপার
Next articleJessore Road: সুপ্রিম রায়: হারিয়ে যাবে শতবর্ষের গাছেরা, মন খারাপ সীমান্ত শহর বনগাঁর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here