আজ দীপান্বিতা কালীপুজো। এই উপলক্ষে দক্ষিণেশ্বর মা ভবতারিণীর বিশেষ পুজোর আয়োজন। চলতি বছরের এই মন্দিরের কালীপুজো ১৬৯ বছরে পড়ল। কালীপুজো উপলক্ষে সকাল থেকেই জমজমাট দক্ষিণেশ্বর।
ভোর থেকেই ভক্তদের লাইন দক্ষিণেশ্বরে। রবিবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় খোলা হয় মন্দিরের দরজা। তারপর হয় নিত্যপুজোর আরতি। এরপর সকাল সাতটায় হয় ধূপারতি। দীপান্বিতা কালীপুজো উপলক্ষে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা রয়েছে আজ। কালীপুজোর পুন্যতিথিতে মায়ের পায়ে অর্ঘ্য অর্পণের জন্য সকাল থেকে ভক্তদের লাইন। চড়া রোদ উপেক্ষা করে মন্দির চত্বরের বাইরের অংশের চাতাল থেকে বালি ব্রিজ পর্যন্ত ভক্তদের লাইন।
মন্দির সূত্রে জানা গিয়েছে, এদিন দুপুর ২টোর পর অমাবস্যা তিথি পড়ছে। দিনভর অন্যদিনের মতোই নিয়ম মতে চলছে পুজো। অমাবস্যা লাগার পর শুরু হবে ভবতারিণী মায়ের বিশেষ পুজো। দেখুন ভিডিও
একই সঙ্গে আজ মহাসমারোহে বিভিন্ন স্থানে পালিত হচ্ছে বাঙালির আলোর উৎসব কালীপুজো। তাই শক্তির দেবীর আরাধনায় মেতে উঠবে গোটা বাংলা। মা কালী আদি শক্তি ও শ্যামা নামেও পরিচিতা। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতেই এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। কালীপুজো একটি হিন্দু উৎসব। ব্রক্ষ্মযামল তন্ত্রগ্রন্থের মতে, মা কালী হলেন বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বাংলার গৃহে বা মন্দিরে মা কালীর মূর্তির নিত্য পুজো হয়ে থাকে। তবে কার্তিক মাসের দীপান্বিতা কালীপুজো বিশেষ জনপ্রিয়। এদিন আলোকসজ্জা ও আতসবাজির মাধ্যমে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় দীপাবলি উৎসব পালিত হয়। দ্বীপান্বিতা কালীপুজোর দিনটিতে অনেকে লক্ষীপুজোও করে থাকেন। তাছাড়া মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে ফলহারিনী কালীপুজোও বিশেষ গুরুত্ব পায়।
সনাতন ধর্মমতে কালী বা কালিকা হলেন শক্তির দেবী। মা কালী অশুভ শক্তির বিনাশ সাধন করেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ভয়ংকরের পুজো করেন। কালীকে এই সংহারী রূপের পরেও আমরা মাতা সম্বোধন করে পুজো- পাঠ করি। কারণ সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি সন্তানের মঙ্গল চান, তিনি মঙ্গলময়ী ও কল্যাণী। হিন্দু শাস্ত্রে বলা আছে যে, তন্ত্র মতে যে সব দেব- দেবীর পুজো করা হয়, তাঁদের মধ্যে কালী পুজো অন্যতম।
সপ্তদশ শতকে বাংলায় কালীপুজোর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে অষ্টাদশ শতকে প্রকাশিত কালী সপর্যাস বিধিতে প্রথমবার দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। সাধক রামপ্রসাদ সেনের গুরু নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকেই বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপুজোর প্রবর্তক বলে মনে করা হয়। কথিত আছে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপুজোকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তবে ঊনবিংশ শতকে বাংলার বিভিন্ন ধনপতি এবং জমিদার কর্তৃক এই পুজো দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। যেমন- ঊনবিংশ শতকে লোকমাতা রানী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
কথিত আছে, ১৮৪৭ সালে অন্নপূর্ণা পুজোর জন্যে রানী রাসমণি কাশীতে তীর্থযাত্রার আয়োজন কালে দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ হয়। তারফলেই দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির গড়ে ওঠে। তবে এই মন্দির তৈরির আগে এই মহীয়সী নারীকে অনেক লড়াইয়ের পথে যেতে হয়েছিল। অবশেষে ১৮৫৫ সালে ৩১শে মে স্নানযাত্রার দিন রানী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে মা কালীকে ‘ভবতারিণী’ রূপে পুজো করা হয়। দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে শুধুমাত্র ভারত নয়, সারা পৃথিবী থেকে দর্শনার্থীরা মায়ের দর্শনের জন্য আসেন। ঊনবিংশ শতকের মহান সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কালীসাধনা স্থল ছিল এই মন্দির। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় মন্দির নির্মাণকালে রানীকে প্রভূত সাহায্য করেন। মূল মন্দিরটি নবরত্ন মন্দির। মূল মন্দির ছাড়াও আছে ‘দ্বাদশ শিবমন্দির’ নামে পরিচিত বারোটি আটচালা শিবমন্দির। তাছাড়া মন্দির চত্বরে কালী মন্দির ব্যতীত একাধিক দেবদেবীর মন্দির অবস্থিত।
বহুকাল ধরে দীপান্বিতা কালীপুজোয় মহা আড়ম্বরের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে কালীপুজো পালিত হয়। এ বছরও মন্দিরে পুরোদমে পুজোর আয়োজন চলছে । রানীর রাসমণির সময়ের সমস্ত রীতি মেনেই পুজো হচ্ছে। পুজোর দায়িত্বে আছেন এখন রানীর উত্তরসূরীরা। রানী রাসমণির এক উত্তরসূরী প্রসূন হাজরা এবারের কালীপুজোর বিষয়ে জানান যে, ” অতিমারির সময় থেকে গত বছর অবধি কালীপুজোর প্রসাদ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ বন্ধ ছিল। কিন্তু এবছর আবার শ্যামা পুজোর পর মায়ের প্রসাদ পাবেন ভক্তরা। তবে দীর্ঘদিন পর পুনরায় শুরু হচ্ছে বলে এবার প্রসাদের পরিমাণ কিছুটা কম হবে। অন্যান্য বারের মতোই ভক্তরা মায়ের পুজো দেখতে পারবেন। এ বছর আরেকটি বিশেষ ব্যাপার থাকছে, সেটি হল মন্দিরের সমস্ত সেবায়েতদের পুজোর পরের দিন বসিয়ে খাওয়ানো হবে। রানীমার প্রচলিত এই প্রথা ১৯৭৬ সালের পর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
দক্ষিণেশ্বরের কালীপুজো অন্যান্য সব জায়গার পুজোর থেকে একটা দিকে একটু আলাদা, সব পুজোর স্থানেই মায়ের পুজোয় কারণবারি (মদ) দেওয়া হয় কিন্তু আমাদের এখানে তার পরিবর্তে নারকেলের জল দিয়ে মায়ের পুজো হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে পুজোয় পশু বলি প্রথা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে আগে এখানে প্রথমে মহিষ এবং পরে ছাগল বলি হতো।”
কালীপুজোয় ভক্তদের ভিড় সামাল দিতে মূল মন্দিরের সব প্রবেশদ্বারই এদিন খোলা। যাতে সবাই গর্ভগৃহে মায়ের ঝলক দেখতে পান। মন্দিরের ভিতর একসঙ্গে ১০০০ জনের দাঁড়ানো ব্যবস্থা। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে মন্দিরে এদিন অতিরিক্ত পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে বাড়তি সিসিটিভি। নাটমন্দিরে বসানো হয়েছে ক্যামেরা। ভিতরে মোবাইল নিয়ে প্রবেশ নিষেধ।
উল্লেখ্য, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে শাক্ত, বৈষ্ণব ও শৈব, তিন ধারাতেই পুজো হয়। দক্ষিণেশ্বরের শিবমন্দিরগুলিতে শৈব ধারার শিব আরাধনা চলে। এদিন রাত পর্যন্ত মন্দিরে পুজো চলবে, সেই উপলক্ষে ভক্তদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা মেট্রোর। দক্ষিণেশ্বর থেকে এদিন রাত দশটায় একট বিশেষ রেক থাকবে যা যাবে কবি সুভাষ। ওই স্টেশন থেকেও দক্ষিণেশ্বেরের উদ্দেশে ঠিক রাত দশটায় ছাড়বে শেষ মেট্রোও।
আজ শক্তির দেবীর আরাধনায় মেতে উঠবে গোটা বাংলা। মা কালী অশুভ শক্তির বিনাশ সাধন করেন। তাই মায়ের কাছে আমাদের প্রার্থনা, সমস্ত অশুভ নাশ করে সবার মধ্যে যেন শুভ বুদ্ধির উদয় হয়।