দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ ‘ফণি’, ‘আমপান’, ‘ইয়াস’-এর পর বাংলার দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং৷
অতি গভীর নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হচ্ছে সিত্রাং (Cyclone Sitrang)। ধেয়ে আসছে বাংলা-বাংলাদেশ সীমান্তের দিকেই। মঙ্গলবার সকালে স্থলভাগে প্রবেশ করবে এই ঘূর্ণিঝড়। বাংলাদেশেই ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য় ল্যান্ডফল হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর। তবে এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়বে দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গেই সবথেকে বেশি ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি উত্তর-পূর্বের একাধিক রাজ্য, ত্রিপুরা, অসম, মিজোরাম, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডেও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
সোমবার সকাল থেকেই কলকাতায় আকাশের মুখভার। কালো মেঘে ছেয়ে রয়েছে আকাশ। সঙ্গে বইছে ঝোড়ো হাওয়া।
গত ৬ ঘণ্টায় উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিকে ঘণ্টায় ১২ কিলোমিটার গতিতে এগিয়েছে সিত্রাং। সোমবার পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্রায় ৭৭০ কিমি দূরে, সাগর থেকে ৫০০ কিমি এবং বরিশাল থেকে ৬৫০ কিমি দূরে অবস্থান করছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং।
গত ২০ অক্টোবর বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া নিম্নচাপ ক্রমে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। সোমবার তা প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
হাওয়া অফিস সূত্রে খবর, প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার পথে এগোচ্ছে সিত্রাং। আগামী ১২ ঘণ্টার মধ্যেই তা পরিণত হবে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। মঙ্গলবার সকালে তা বরিশালের কছে তিনকোনা দ্বীপ ও সন্দ্বীপের কাছে আছড়ে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে হাওয়া অফিস।
হাওয়া অফিসের খবর অনুযায়ী, রবিবার বিকেল পর্যন্ত ‘সিত্রাং’ পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ৭৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ছিল ঘূর্ণিঝড়। সাগরদ্বীপ থেকে ৫৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং বাংলাদেশের বরিশালের ৭৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
সোমবার, ২৪ অক্টোবর ‘সিত্রাং’ প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। তার পর আরও উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে এগোতে পারে। আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন, ২৫ অক্টোবর, মঙ্গলবার সকালে বরিশালের কাছে তিনকোণা দ্বীপ এবং সন্দ্বীপের মধ্যে দিয়ে তা আছড়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ উপকূলে।
পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, নবান্নে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে জেলাশাসকদের পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যসচিব। উপকূল থেকে মানুষদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলা দলের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে মৎস্যজীবীদের জন্যও। ২৩ অক্টোবর থেকে মৎস্যজীবীদের সাগরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যাঁরা সমুদ্রে রয়েছেন, সেই মৎস্যজীবীদের শনিবারের মধ্যেই ফিরে আসার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় জেলাগুলিতে সোম এবং মঙ্গলে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর, হাওড়া এবং হুগলিতেই। উপকূলবর্তী এলাকায় জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ১৪টি দল মোতায়েন করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই উপকূলবর্তী এলাকায় মাইকিং শুরু করেছে প্রশাসন। সুন্দরবন এলাকায় বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ১৪টি দলের মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনায় ২টি, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৪টি, পূর্ব মেদিনীপুরে ৩টি, কলকাতায় ২টি, পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলী এবং নদিয়াতে ১টি করে দল মোতায়েন করা রয়েছে।
আবহাওয়া দফতর সূত্রে খবর, রবিবার রাতের পর থেকেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে দক্ষিণবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকায়। বাংলাদেশের দিকে ঝড়ের অভিমুখ হলেও এ রাজ্যেও তাণ্ডবলীলা চালাতে পারে ঘূর্ণিঝড় সিত্রং। হাওয়া অফিস সূত্রে খবর, সুন্দরবন এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
রবিবার সাংবাদিক বৈঠকে আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে দুই ২৪ পরগনায়। দুই ২৪ পরগনা ছাড়াও ঝড়ের তাণ্ডবের মুখে পড়তে পারে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা।
সোমবার দুই ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুরে ঘণ্টায় ৪০-৫০ কিমি বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইবে। হাওয়ার সর্বোচ্চ বেগ হতে পারে ঘণ্টায় ৬০ কিমি। মঙ্গলবার হাওয়ার বেগ আরও বাড়বে। দুই ২৪ পরগনায় ঘণ্টায় ৭০-৯০ কিমি বেগে বইবে হাওয়া। সর্বোচ্চ বেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১০০ কিমি। পূর্ব মেদিনীপুরে হাওয়ার সর্বোচ্চ বেগ হতে পারে ঘণ্টায় ৮০ কিমি।
হাওয়া অফিস জানিয়েছে, রবিবার রাত থেকে মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে দুর্যোগের ঘনঘটা থাকবে। এই সময়ের মধ্যেই ঘূর্ণিঝড়ের দাপট বেশি অনুভূত হবে। সুন্দরবন এলাকায় ফেরি পরিষেবা বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। দিঘা, মন্দারমণি, শঙ্করপুর এলাকায় পর্যটকদের সমুদ্রে নামতে নিষেধ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার ভোরে বাংলাদেশ উপকূলের তিনকোনা দ্বীপ ও সন্দ্বীপের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করবে ঝড়। বরিশালের কাছে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের। এই নিয়ে তৎপর রয়েছে বাংলাদেশ সরকারও।
ঝড়ের দাপটে বাংলাদেশের ১৯টি জেলায় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে সতর্ক করা হয়েছে। সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হয়েছে মৎস্যজীবীদের। সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে সমুদ্র থেকে ফিরতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আছড়ে পড়লে সে দেশের উপকূলের ৭৩০ কিমি এলাকায় প্রভাব পড়বে। কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় ঝড়ের প্রভাব পড়তে পারে।
‘সিত্রাং’-এর কারণে সামনের সোমবার বঙ্গোপসাগরে প্রতি ঘণ্টায় হাওয়ার গতিবেগ থাকতে পারে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। কোথাও কোথাও ঝোড়ো হাওয়ার গতিবেগ ঘণ্টা প্রতি ৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। ঝোড়ো হাওয়ার তেজ থাকবে উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতেও।
মঙ্গলবার আরও বাড়তে পারে হাওয়ার গতি। সমুদ্রে ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে। সেই গতিবেগ ১১০ কিলোমিটারের মাত্রাও ছাড়াতে পারে। মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে ঝড়বৃষ্টির দাপট ধীরে ধীরে কমবে। বুধবার থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বৃহস্পতিবার আবার রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ দেখা যাবে।
পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলিতে ঝড়-বৃষ্টির দাপট থাকবে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে সবথেকে বেশি প্রভাব পড়বে ত্রিপুরায়। ২৪ ঘণ্টায় সর্বাধিক ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়া দফতরের তরফে ইতিমধ্যেই ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডে লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। কমলা সতর্কতা জারি করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও অরুণাচল প্রদেশে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাব থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য ত্রিপুরা সরকারের তরফে আগামী ২৬ অক্টোবর অবধি স্কুল, কলেজ সহ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের জন্য সমস্ত সরকারি কর্মীদের ছুটিও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
২০২০ সালে আবহাওয়া দফতরের তালিকাভুক্ত ১৬৯টি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে একটির নাম দেওয়া হয় ‘সিত্রাং’।
‘সিত্রাং’ নামটি তাইল্যান্ডের দেওয়া। উচ্চারণ অনুযায়ী, ‘সি-তরাং’। ‘সিত্রাং’ আসলে তাইল্যান্ডের বাসিন্দাদের একটি পদবি। ভিয়েতনামের ভাষায় আবার এর অর্থ পাতা।
উপকূলীয় জেলাগুলির বিস্তীর্ণ এলাকার জনজীবন গত দু’তিন বছরে একাধিক ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত। তাই নতুন ঘূর্ণিঝড় আসার খবর পেয়েই এই এলাকাগুলিতে বসবাসকারী মনে নতুন আশঙ্কা দানা বেঁধেছে।
ঘূর্ণিঝড় নিয়ে সতর্ক রয়েছে কলকাতা পুরসভাও। ঝড় মোকাবিলায় পুরসভা আগে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। বিভিন্ন দফতরকে জরুরি প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কলকাতা পুরসভার কমিশনার বিনোদ কুমার।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে আমপান ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে তছনছ হয়েছিল দুই ২৪ পরগনা। পাশাপাশি কলকাতেও বহু গাছ ভেঙে পড়েছিল। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছিল একাধিক এলাকা।
উৎসবের আবহে এই ঘূর্ণিঝড় কতটা তাণ্ডব চালাবে এবং এর জেরে কতটা ক্ষতি হবে সেই নিয়ে আশঙ্কায় রাজ্যবাসী।
প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকেও। যেখানে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে এনডিআরএফের অতিরিক্ত বাহিনী পাঠানোর কথা বলা হয়েছে।