দেশের সময় ,কলকাতা : বিচারপতি কখনওই ‘ভগবান’ হতে পারেন না। কলকাতায় এসে এমনই মন্তব্য করলেন দেশের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। তাঁর মতে, যদি কোনও বিচারপতি নিজেকে ‘ভগবান’ ভেবে নেন, তাহলে ‘বিপদ’। কারণ, একজন বিচারপতির মধ্যে ঐশ্বরিক গুণ নয়, দরদ, সহানুভূতি, সহমর্মিতার মতো মানবিক গুণ থাকা বেশি প্রয়োজন।
শনিবার কলকাতা হাইকোর্টের বার লাইব্রেরির দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমির আলোচনা সভায় যোগ দিয়েছিলেন দেশের প্রধান বিচারপতি। সেখানেই তিনি একথা বলেন। প্রসঙ্গত, কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি তথা বর্তমানে বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে একসময় ‘ভগবান’ বলে পোস্টার দিয়েছিলেন আন্দোলনকারী চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ। ফলে দেশের প্রধান বিচারপতির এদিনের মন্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
যদিও প্রধান বিচারপতি তাঁর বক্তৃতায় কোনও ব্যক্তির নাম করেননি। যদিও অনেকেই বলছেন, রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সম্প্রতি একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ রায় দেন কলকাতা হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থীর কাছে রাতারাতি ‘মসিহা’ হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর কেন্দ্রের শাসক দলে যোগদান এবং ভোটে প্রার্থী হওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা চর্চা শুরু হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতায় দাঁড়িয়ে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে বলে মনে করছে তথ্যাভিজ্ঞ মহল। শুক্রবার কলকাতায় আসেন শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি।
শনিবার ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমির অনুষ্ঠানে ছিলেন তিনি। একই মঞ্চে দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। প্রধান বিচারপতি বলেন, “আদালতকে বলা হয় ন্যায় এবং বিচারের মন্দির। আমরা নিজেদেরকে সেই মন্দিরের দেবতা ভেবে ভুল করি। এটা খুব বিপদের। মনে রাখতে হবে আমাদেরও নিজস্ব চিন্তাভাবনা রয়েছে। সেই চিন্তাভাবনার সঙ্গে বিচারকে গুলিয়ে ফেললে হবে না।” প্রধান বিচারপতি বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সকলকে মনে করিয়ে দেন, ‘‘সাংবিধানিক নৈতিকতা বলে বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করুন এবং সহনশীল হোন। আমার সামনে আদালতকে কেউ মন্দির বললে আমি তাঁদের বাধা দিই। কারণ, মন্দির বললেই মনে হয় বিচারপতিরা দেবতা। কিন্তু তা নয়, বিচারপতিরা মানুষের সেবক।” প্রধান বিচারপতির পরামর্শ, “বিচারপতিরা বিচার করুন, কিন্তু অন্যের সম্পর্কে আগেভাগে কোনও ধারণা তৈরি করে ফেলবেন না। সহানুভূতি রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের সামনে যাঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁরাও মানুষ।’’
প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্যের ঠিক আগেই বিচার ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা বজায়ের আর্জি জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধান বিচারপতির কাছে মমতার আর্জি, “আমি কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে বলছি না, কাউকে আঘাতও করতে চাই না। তবে এটা বলতে চাই, বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব থাকলে মানুষ কোথায় যাবে? বিচার ব্যবস্থা আমাদের কাছে পবিত্র, মন্দির-মসজিদ-গির্জা-গুরুদ্বারের মতো। সরকার বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে আছে। আমার অনুরোধ, বিচার ব্যবস্থায় কোনওরকম রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব থাকা উচিত নয়। বিচারব্যবস্থা সৎ এবং নিরপেক্ষ থাকা উচিত। বজায় রাখা উচিত গোপনীয়তাও।”
তমলুকের বিজেপি সাংসদ অবশ্য বলেছেন, ‘‘প্রধান বিচারপতির মন্তব্য নিয়ে আমি কোনও পাল্টা মন্তব্য করব না। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথার প্রতিক্রিয়া দেব। কারণ, তিনিও রাজনাতির লোক। আমিও রাজনীতির লোক।’’ অভিজিৎ বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কি প্রমাণ করতে পারবেন যে, একটা রায়ও আমি পক্ষপাতিত্ব করে দিয়েছি?”