চৈত্র শেষের বিকেলে চড়কতলায় বেজে উঠেছে ঢাক, ঢোল, কাঁসর। ভিড় করেছে ছেলে-বুড়ো সকলেই। কাঠের প্রকাণ্ড খুঁটির উপরে, অনেকটা উঁচুতে, আংটায় ঝুলে থাকা জনা দুয়েক সন্ন্যাসী ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছেন। সেই দৃশ্য দেখতে নীচে অগুনতি মানুষের ভিড়। ঘুরপাক খেতে খেতে আচমকাই ঝুলে থাকা সেই সন্ন্যাসীদ্বয় নীচে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের উদ্দেশে ছুড়ে দিলেন বেল, কাঁচা আমের মতো একাধিক ফল। এরই মাঝে ভিড় ঠেলে একটু পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য চড়ক গাছ ছুঁতে এগিয়ে গেলেন কিছু মানুষ। এটাই গ্রামবাংলার চড়কের অতি পরিচিত ছবি।
দেখুন ভিডিও
তবে কলকাতায় চড়ক পুজো হলেও সং সেজে পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য বেশ বিরল। তবে চড়ক হয়। এবং সেই উপলক্ষে মেলাও বসে। আজও চড়কের মেলা বসে বিডন স্ট্রিটের ছাতুবাবুর বাজারে আর কলেজ স্কোয়্যারে। তবে কলেজ স্কোয়্যারের মেলাটি দিনে দিনে ছোট হয়ে এসেছে।
ছাতুবাবুর বাজারের মেলাটি আজও কলকাতার সবচেয়ে বড় চড়কের মেলা। চৈত্র সংক্রান্তির দিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই এখানে মানুষের ঢল নামে। প্রথমত চড়ক দেখতে, দ্বিতীয়ত মেলার আকর্ষণে। তবে, শহরে দিনে দিনে কমে আসছে মেলার সংখ্যা।
অখিল ভারতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন। সংস্কার ভারতী কেন্দ্রীয় কোষ টোলী সদস্য ভরত কুণ্ডু এবং
কলকাতার বাসিন্দা সংগীত শিল্পী রাজ্যশ্রী ব্যানার্জীর কথায়, আজও এখানে কিছুটা হলেও পুরনো সেই মেলার আমেজ পাওয়া যায়। গেরস্থালির দৈনন্দিন জিনিসপত্র থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর শৌখিন সামগ্রীও মেলে সেখানে। পাশাপাশি এখানেই পাওয়া যায় বসিরহাটের বঁটি, দা, ছুরি থেকে শুরু করে কাঠের নানা জিনিস। চৈত্রসংক্রান্তির বিকেল থেকে শুরু করে সারা রাত অতিক্রম করে পর দিন দুপুর পর্যন্ত চলে এই মেলাটি।
সে কাল থেকে এ কাল চড়কের আকর্ষণ খুব একটা বদলায়নি। শুধু বদলেছে কিছু আচার অনুষ্ঠান। তবে গ্রামের সঙ্গে শহরের ইদানীং কিছুটা ফারাক দেখা দিয়েছে। গ্রামবাংলায় আজও চৈত্রের শুরু থেকেই ধ্বনিত হয় ‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে’। সমাজের প্রান্তিক স্তরের নারী-পুরুষের একাংশ সন্ন্যাস পালন করেন। কেউ কেউ আবার শিব-পার্বতী সেজে হাতে ‘ভিক্ষাপাত্র’ নিয়ে বের হন। সারা দিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে আতপচাল, রাঙাআলু, কাঁচা আম, কাঁচকলা-সহ নানা আনাজের সঙ্গে পয়সাকড়ি সংগ্রহ চলে। সন্ধেবেলা সেই চাল-আনাজ সেদ্ধ করেই ওঁরা আহারপর্ব সারেন।
বাঙালি সংস্কৃতির একফালি ঐতিহ্য নিয়ে আজও এভাবেই বেঁচে আছে কলকাতার ছাতুবাবুর চড়ক I বর্ষশেষ আর নববর্ষের সন্ধিক্ষণের মতোই চড়ক যেন অতীত আর বর্তমানের একটা যোগসূত্র। কিছু হারিয়ে যায় আর কিছু থেকে যায়।