দেশের সময় : শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বৃহস্পতিবার সকালে ৮টা ২০ নাগাদ পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতেই মারা যান তিনি।মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
বৃহস্পতিবার সকালে প্রাতঃরাশের পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকদের ডাকা হয়। কিন্তু ততক্ষণে তিনি মারা গিয়েছেন। মৃত্যুর কারণ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বলে জানা গেছে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ মার্চ। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্র। কলকাতায় জন্ম হলেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পূর্বপুরুষদের আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশে। স্কুল জীবনে তিনি ছিলেন শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ের ছাত্র। পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স নিয়ে বিএ পাস করেন তিনি। যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে একটি সরকারি স্কুলে।
এক যুগেরও বেশি সময় আগে রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। কয়েক মাস আগেই মারাত্মক শারীরিক সমস্যায় ভুগেছিলেন, শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছনোয় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। এছাড়াও ছিল নানাবিধ বার্ধক্যজনিত সমস্যা। গত কয়েক বছর ধরে ঘরেই নিয়মিত চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে ছিলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সকালে বুদ্ধদেবের মৃত্যুর খবর জানান তাঁর ছেলে সুচেতন ভট্টাচার্য।
কম্যুনিস্ট রাজনীতিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন সিপিএম নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত।
১৯৭৭ সালে কাশীপুর–বেলগাছিয়া বিধানসভা আসন থেকে প্রথম বিধায়ক হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দলের রাজ্য কমিটির সদস্য হয়েছিলেন ১৯৭২ সালেই। আবার যে বছর তিনি দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হয়েছিলেন সেই ১৯৮২ সালেই তিনি কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যান। এরপর তাঁর বিধানসভা কেন্দ্র পরিবর্তন করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় যাদবপুরে। ১৯৮৭ থেকে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত যাদবপুর কেন্দ্র থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি।
প্রথমবার বিধানসভায় জিতেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মন্ত্রী হয়েছিলেন। তথ্য ও জনসংযোগ দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে তিনি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪–তে আমন্ত্রিত হিসেবে হলেও দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে তাঁর অন্তর্ভুক্তি হয় ১৯৮৫ সালে। ২০০২ সালে তিনি পলিটব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন।
বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় দ্বিতীয়বারের জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আসেন ১৯৮৭ সালে। তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে। সাময়িকভাবে সামাল দিয়েছেন নগরোন্নয়ন ও পর্যটন বিভাগও। এরপর ১৯৯৩ সালে মতবিরোধের জেরে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেও কয়েকমাস পরে ফের বুদ্ধদেব ভট্টচার্যকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৯৬ সালে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বয়সজনিত কারণের জন্য ১৯৯৯ সালে উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দলের পক্ষ থেকে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০০০ সালের ৬ নভেম্বর তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাজ্যের সপ্তম মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন রাজ্যে শিল্পায়নের বিষয়ে তিনি উদ্যোগী হন। তাঁর এই প্রয়াসকে সামনে রেখে সেইসময় দলের পক্ষ থেকে বলা হত, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। আইটি সেক্টরের উন্নতির পাশাপাশি তিনি রাজ্যে ভারী শিল্পগঠনেও উদ্যোগী হন। উদ্যোগী হন সিঙ্গুরে টাটাদের ছোট মোটরগাড়ি ন্যানো কারখানা স্থাপনেও। কিন্তু কারখানার জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সমস্যার জেরে সেই কারখানা শেষ পর্যন্ত আর তৈরি হয়নি। যে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে তিনি টানা জিতেছেন, সেই যাদবপুর কেন্দ্রেই ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তিনি তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মণীশ গুপ্তর কাছে ১৬,৬৮৪ ভোটে পরাজিত হন। এরপর ধীরে ধীরে শারীরিক কারণে তিনি নিজেকে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরিয়ে নেন।
২০০০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে পরাজয়ের পর সক্রিয় রাজনীতি থেকে ক্রমশই দূরে সরে যেতে থাকেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান সিপিএম নেতা শেষবার ব্রিগেডে গিয়েছিলেন ২০১৯ সালে। তবে তখনও তিনি বেশ অসুস্থ, নাকে লাগানো ছিল অক্সিজেনের নল। সভামঞ্চের নীচে গাড়িতে মিনিট পনেরো বসে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন তিনি।
তারপর থেকে ধীরে ধীরে তাঁর শরীর খারাপ হতে থাকে। শ্বাসকষ্ট সহ একাধিক সমস্যা নিয়ে বার বার হাসপাতালমুখী হতে হয়েছে তাঁকে। গত বছর অগস্টেই ১২ দিন পর হাসপাতালে থাকার পরে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে ফিরেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই থেকে বাড়িতেই বাইপ্যাপ সাপোর্টে ছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে লাগানো ছিল রাইলস টিউবও। একটা কার্ডিয়াক মনিটরও ছিল, যাতে বুদ্ধবাবুর হার্টরেট, রক্তচাপ ও অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাত্রা দেখা যেত।
তবে সেসব পার করে, বৃহস্পতিবার সকালে এল দুঃসংবাদ। বৃহস্পতিবার তাঁর মৃত্যুতে একটা যুগের অবসান হল।