Bird: এক পাখি কীভাবে লোকসংস্কৃতিতে! বাংলার ঘুঘু : লিখছেন অরিত্র ঘোষ দস্তিদার ও ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

0
2019

‘ঘুঘু’ বরাবরই এক রহস্যময় পাখি। ‘ভিটেয় ঘুঘু চড়ানো’ প্রবাদের মধ্যে বংশনাশের বিশ্বাস এবং অভিশাপ আছে। এবং প্রকারান্তরে হুমকিও। ক্ষমতার মদমত্তে থেকে কারও বাড়িতে ‘সাদা থান’ পাঠানো বা বিধবা করে দেবার হুমকিও যা, ভিটেয় ঘুঘু চড়াবো বলাও তাই।

এরই বিপ্রতীপে ‘ঘুঘুর বিয়ে’ দেওয়া মানেই দ্বিপ্রহরের নিঃশব্দে ভিটে মাটিতে ঘুঘুর পদচারণার ধারাকে মুছে দেওয়া। নিদাঘ মধ্যাহ্নে, যখন ঘামাছি-গরমে দরজা এঁটে ঘুমিয়ে পড়েছে পুরো গাঁ, তখন গাছের ছায়াতলের শাখায় থেকে থেকেই গুরু গম্ভীর স্বরে ডেকে ওঠে ঘুঘু৷ যেন এক অতীন্দ্রিয় পরিবেশ, চারপাশ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, একটা চাপা আর্তনাদ তারই মধ্যে বেরিয়ে আসছে। এই যে ভিটেয় ঘুঘু চড়ানোর ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’, তারই উল্টোভাবে ‘হোয়াইট ম্যাজিক’-এর অনুশীলন হল ঘুঘুর বিয়ে দেওয়ার অনুষ্ঠান। ঘুঘুপাখির মনোরঞ্জন করলে সংসার পুত্র কন্যায় যেন ভরে উঠবে! অনুকরণাত্মক যাদুক্রিয়া বা তার প্রতিক্রিয়া হল বাংলার লোকসংস্কৃতির এক গভীর মনস্তত্ত্ব। কালচারাল অ্যান্থোপলজির গভীর পাঠ।

“ঘুঘু মলো চাল পিটুলি খেয়ে,
আজ ঘুঘুর অধিবাস
কাল ঘুঘুর বিয়ে।”

“আজকুয়া ডুপির কেলমেল্
কালকুয়া ডুপির বিয়া।
ডুপির মার’ নিত’ আইচে
বেলাইন তলা দিইয়া।”

‘ডুপি’ মানে ঘুঘু, ‘কেলমেল’ মানে অধিবাস, ‘আজকুয়া’ শব্দের অর্থ আজকে, ‘কালকুয়া’ মানে কালকে।

বাংলায় বহু ধুরন্ধর, সুযোগসন্ধানী, লোভী মানুষকে এককথায় ‘ঘঘু’ বা ‘ঘুঘুনাথ’ বলে অভিহিত করা হয়, যারা সুযোগ পেলেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে৷ একটি প্রচল কথা এইরকম “ঘুঘু দেখাছো, ফাঁদ দেখোনি”। অর্থাৎ সেই ধুরন্ধর লোকের মোকাবিলা যে করতে পারে, ষড়যন্ত্র ভেঙে দিয়ে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারে, তারই পোষাকি নাম ‘ফাঁদ’।

মানুষ যখন প্রকৃতি বিষয়ে অসচেতন ছিল, তখন ঘুঘুর মতো পরিচিত বন্য পাখির মাংস খাবার লোভে ফাঁকা জায়গায় ফাঁদ পেতে রাখতো। ফাঁদের চারণক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিত ছোটো দানা। দানা খাবার লোভে ধরা পড়তো ঘুঘু। এইভাবে বহু ঘুঘু মারা হত। বাংলায় ঘুঘুর বহু প্রজাতি এইভাবে কমে গেছে। এখন ছিটছিটে দাগের তিলিয়া ঘুঘু বা Spotted Dove এবং কণ্ঠিঘুঘুই দেখা যায়, তবুও তাদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। কীটনাশকের বিষক্রিয়াই ইদানীং মূল সমস্যা।

বাংলার শিশু-মহলে যে ঘুঘুর প্রজাতিটি সবচাইতে পরিচিত তা হল তিলিয়া ঘুঘু বা Spotted Dove: Streptopelia chinensis ; এছাড়াও দ্বিতীয় পরিচিত ঘুঘুটি হল কণ্ঠিঘুঘু বা Eurasian Collared Dove: Streptopelia decaoto ; তৃতীয় পরিচিত প্রজাতির নাম লাল কণ্ঠিঘুঘু বা Red Collared-Dove: Streptopelia tranquebarica। এই সব কটি প্রজাতিই বর্তমানে বিরল। এরা সকলেই Columbidae পরিবারের অন্তর্গত এবং Columbiformes বর্গের সদস্য। এই পরিবারের অন্য পাখিগুলির মধ্যে রয়েছে পায়রা, হরিয়াল বা সবুজ পায়রা, ব্লু রক পায়রা।

ঘুঘু আবাস সন্নিহিত থেকেও কিছুটা নির্জন স্থান পছন্দ করে। অরণ্যের উপান্তেও তাদের দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলে উঁচু তারের উপর, খু্টিতে, গাছের শাখাপ্রশাখার মধ্যে বসে থাকতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে গুরুগম্ভীর ডাক ডেকে স্থানটির নীরব নির্জনতায় আবিষ্ট করে। বাংলার লোকসংস্কৃতিতে তাই নির্জন রাতকেও ঘুঘুর আবহে আখ্যা দেওয়া হয় ‘ঘুঘুটি রাত’।
“ঘুঘুটি ঘুঘুটি রাত ঘুরঘুটি।
টেরিটি বাজারে রাত দশটি।”

Previous articleShyam Saran Negi : প্রয়াত শ্যাম শরণ ,দেশের প্রথম নির্বাচনে ভোটদানকারী
Next articleSarva Shiksha Abhiyan: অবশেষে কেন্দ্র থেকে ৯৫৫ কোটি বকেয়া টাকা পেল রাজ্য সরকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here