
কলকাতা : সারা পৃথিবীর কাছে বাঙালি তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির জন্য যেমন পরিচিত তেমনই পরিচিত তার বারোমাসে তেরো পার্বণের জন্য। আর তার এই পার্বণ সন্দেশ ছাড়া সুসম্পন্ন হয় না; যে কোনও আনন্দ অনুষ্ঠান উৎসবের সঙ্গে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মিষ্টি। ভোজন রসিক বাঙালির খাবার পাতে মিষ্টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও একসময় ছানা তৈরি জানত না। আগে বাংলায় মিষ্টি সাধারণত দুধ থেকে তৈরি করা হত; দুধকে ফুটিয়ে জাল দিয়ে ঘন করে তার সঙ্গে নারকেল, গুড়, চাল বা ডাল যোগ করা হত।
পর্তুগিজ নাবিকরা প্রথম ইউরোপীয় উপনিবেশকারী যারা আমাদের দেশে ১৫১০ সাল নাগাদ আধিপত্য বিস্তার করে। তারা আমাদের কাজু, তামাক, লঙ্কার ব্যবহার ছাড়াও দুধ থেকে ছানা তৈরিও শিখিয়েছিল। এই ছানাকে আরও সুস্বাদু করার জন্য বাঙালি নিজস্ব শিল্প প্রতিভায় তার সঙ্গে গুড় বা চিনি মিশিয়ে একরকম মাখা তৈরি করল। সেই মাখাই আজকের মিষ্টির সম্রাট সন্দেশের পূর্বসূরী। পরবর্তীকালে নতুন প্রজন্মের মিষ্টি বিক্রেতারা প্রতিযোগিতা এবং মানুষের পরিবর্তনশীল রুচি অনুযায়ী প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন সন্দেশ তৈরি করে চলেছেন যারমধ্যে অন্যতম কলকাতার বেশকিছু নামীদামি মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান।

আমাদের বারোমাসে তেরো পার্বণের শুরু বাংলার নববর্ষ থেকেই। আর সেই বাংলার নববর্ষে বাঙালির পাতে মিষ্টি থাকবে না তা কি করে হয়। আর সেই নস্ট্যালজিয়া বজায় রাখতেই কলকাতার ঐতিহ্যশালী প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন বিক্রেতা কে সি দাসের বর্তমান কর্ণধার ধীমান দাস দেশের সময়কে জানালেন, বাংলার নববর্ষ উপলক্ষ্যে রয়েছে নববর্ষিকা, বাটার স্কচ ক্রাশ দিয়ে তৈরি বাটার স্কচ রসগোল্লা এবং ডাব সন্দেশ। ডাব সন্দেশটি দেখতে সম্পূর্ণ শীষ সহ ডাবের মতন যার গায়ে স্বস্তিকা আঁকা এবং সন্দেশের ভিতরে রয়েছে ডাবের জল এবং শাস।

সন্দেশের দাম ৩৪টাকা থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে। এছাড়াও গন্ধরাজ সন্দেশ, রসমালঞ্চ রসমালাইয়ের চাহিদা এইসময় বেশি থাকে। নববর্ষের দিন যারা নিরামিষ খান তাদের জন্য কে সি দাসের নববর্ষ উপলক্ষ্যে রয়েছে বেশকিছু প্ল্যাটার যারমধ্যে হাল্কা ভোজ, তৃপ্তি ভোজ, মহা ভোজ। ৯৯ টাকার হাল্কা ভোজের মধ্যে থাকছে দুটো রাধা বল্লভী, দুটো লুচি, একটা বেগুন ভাজা, ছোলার ডাল, একটা ছোটো রসগোল্লা, আর একটা আলুরদম।

১৯১ টাকার তৃপ্তিভোজে রয়েছে দুপিস লুচি, বেগুন ভাজা, ৭৫ গ্রাম বাসন্তী পোলাও, দুটো ছানার কালিয়া, দুপিস আলুর দম, একটি ২৩টাকার রসগোল্লা এবং চাটনি। মহাভোজ থালিতে রয়েছে দুপিস রাধা বল্লভী, ১৫০ গ্রাম পোলাও দুটো ছানার কালিয়া, দুটো আলুর দম, দুপিস ধোকার ডালনা, একটা ছানার চপ, একটি ২৩ টাকার রসগোল্লা, আর চাটনি। এছাড়াও কম্বো মিল আছে ১৩৪ টাকার যার মধ্যে রয়েছে ৪ পিস কড়াইশুটির কচুরি, দু পিস ধোকার ডালনা, ছোলার ডাল এবং একটি ভেজ চপ। ৯০ টাকার মধ্যে রয়েছে ৪ পিস লুচি, বেগুন ভাজা, দুপিস আলুর দম এবং ছোলার ডাল।

বাঙালির বর্ষবরণে কলকাতার অন্যতম মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান বলরাম মল্লিকের বর্তমান কর্ণধার সুদীপ মল্লিক দেশের সময়কে জানালেন, প্রতিবারের এবারেও নববর্ষ উপলক্ষ্যে তাদের রয়েছে ম্যাঙ্গো জিলাটো সন্দেশ, নববর্ষ ছাপ দেওয়া কেক সন্দেশ, বিভিন্ন সাইজের কড়া পাকের সন্দেশ, রয়েছে নববর্ষ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন বিশেষ ধরণের বক্স যাতে থাকছে পাঁজি, পেঁচা এবং নববর্ষ ছাপ দেওয়া চৌকো আকৃতির বড় একটি সন্দেশ, এছাড়াও রয়েছে নববর্ষের হাঁড়ি, পান সন্দেশ, বিভিন্ন ম্যাঙ্গো সন্দেশ, বিভিন্ন নোনতা, কাজুবাদাম সহ চার পাঁচ রকম সন্দেশের প্ল্যাটার ইত্যাদি। এই সব কিছুর দাম ২০০ থেকে শুরু করে ১০০০ টাকার মধ্যে রয়েছে।

প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন বিক্রেতা ভীম নাগের বর্তমান কর্ণধার প্রদীপ নাগ জানালেন শুধুমাত্র নববর্ষ উপলক্ষ্যে নয় বারোমাস তাদের যে সমস্ত মিষ্টি বেশ জনপ্রিয় তারমধ্যে অন্যতম জাফরানের বাদশাভোগ, গোলাপী পেঁড়া, জাফরান পেস্তার দিলখুশ, লেবু সন্দেশ, রাতাবী, জলভরা কড়াপাক, আতা, কাজু স্টাফিং এর পান সন্দেশ, চকোলেট ইত্যাদি। এই সমস্ত সন্দেশ ৩০টাকা থেকে ৪০টাকার মধ্যে।
মাখনলাল এন্ড সন্স এর অন্যতম কর্ণধার সায়ন দাসও জানালেন তাদের শুধুমাত্র নববর্ষ বলে বিশেষ কিছু নেই, বরং ফিউসানের বদলে ট্রাডিশনাল মিষ্টিই রয়েছে। কিন্তু এই সময়ে যে সমস্ত সন্দেশের বেশি চাহিদা রয়েছে তারমধ্যে জলভরা, কেশর কেক, চকোলেট জলভরা, বাটার স্কচ জলভরা, অর্ধ চন্দ্রাকার কেশর পেশোয়ারি, ম্যাঙ্গো দই এই সমস্ত সন্দেশই ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকার মধ্যে।

নববর্ষের দিন সকাল থেকেই বাঙালির শুরু হয়ে যায় বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ শুভেচ্ছা বিনিময় আর সেই শুভেচ্ছা বিনিময় তো খালি মুখে বা খালি হাতে হয় না সেই আড্ডায় চা এর সঙ্গে টা এসেই যায় তাও যদি হয় এহেন মিষ্টি সুখে তাহলে আর কথাই নেই। বাঙালির সেই রসনা তৃপ্তির কথা মনে রেখেই দেশের সময়ের নববর্ষ উপলক্ষ্যে এই বিশেষ প্রতিবেদন।