- জাকির হোসেন, ঢাকা: উদ্ধার হল বাংলাদেশের সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনারের দেহের একাংশ। মঙ্গলবার বিকেলে নিউ টাউন থানার সঞ্জীবা আবাসনের বিইউ ৫৬ ফ্ল্যাটের সেফটি ট্যাংক থেকে প্রায় ৪ কেজি ওজনের দেহাংশের মাংস উদ্ধার করেছে সিআইডি।
প্রত্যক্ষদর্শী এবং আবাসনের সুয়ারেজ সিস্টেমের কর্মী সিদ্ধেশ্বর মন্ডল জানিয়েছেন, একটি কাঁচের জারে নুন মিশ্রিত জলে মাংসগুলি রাখা হয়েছে। অনেকটা পকোড়ার মতো দেখতে ছিল সাংসদের দেহাংশ। এই মাংসের অংশগুলি ঘাতক কসাই জিহাদ হাওলাদার ওয়াশরুমের কমোটের ফেলে দিয়েছিল বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা।
কোনওভাবে দেহাংশ পাইপ বা বাথরুমে ফ্ল্যাশ করে বাইরে বার করে দেওয়া হতে পারে, এমনটা আগেই সন্দেহ করেছিলেন গোয়ান্দারা। মঙ্গলবার দেহাংশের খোঁজে সাংসদ যেখানে খুন হয়েছেন, সেখানকার নিকাশি পাইপ, সেপটিক ট্যাঙ্ক পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া আবাসনের উল্টোদিকে বাগজোলা খালেও তল্লাশি চলে। দিনভর টানা তল্লাশি অভিযানের পর সেপটিক ট্যাঙ্ক ভাঙা হয়। এরপর সন্ধে নাগাদ সেই পাইপ থেকেই সাংসদের কিছু মরদেহের খণ্ডাংশ পাওয়া গেছে বলে জানায় তদন্তকারী দল।
আনোয়ারুল হত্যাকাণ্ডের তদন্তে রবিবার বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় এসেছে ঢাকার গোয়েন্দাদের তিন সদস্যের দল। মঙ্গলবারও সিআইডির সঙ্গে তদন্ত চালান বাংলাদেশ পুলিশের আধিকারিকরা। তদন্তের গতিপ্রকৃতির উপর আস্থা রয়েছে বলে এদিন জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান হারুন রশিদ। একইসঙ্গে বাংলাদেশের গোয়েন্দা প্রধানের অনুরোধ করেন, যে আবাসনে সাংসদ ছিলেন, সেখানকার বাথরুমের কমোডের ফ্রাশের নিকাশিও যেন পরীক্ষা করে দেখা হয়। গোয়েন্দাদের সন্দেহ ছিল, বাথরুমে গিয়ে ফ্লাশ করা হয়ে থাকতে পারে সাংসদের দেহের টুকরোগুলি।
মঙ্গলবার সকালে ঢাকা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান হারুন রশিদ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, ‘তদন্ত ঠিক পথে এগোচ্ছে। আমরা এখনও দেহাংশ উদ্ধারের ব্যাপারে আশাবাদী। সিআইডিকে আমরা হাতিশালা কাঠের ব্রিজ লাগোয়া এলাকায় তল্লাশি চালানোর জন্য অনুরোধ করেছি। আমাদের হাতে ইতিমধ্যে যা তথ্যপ্রমাণ রয়েছে তাতে এই এই অপরাধীদের সাজা দিতে বেগ পেতে হবে না।’
বাংলায় এসে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন বাংলাদেশের সাংসদ আনোয়ার উল আজিম! শুধু খুনই নয়, কসাই দিয়ে গোটা দেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে টুকরো টুকরো করে কাটা হয়েছে। এরপর দেহাংশ ট্রলি ব্যাগে করে খালে ফেলে দেওয়া হয়েছে। গোটা ঘটনাই পরিল্পনামাফিক বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। কলকাতায় বাংলাদেশের সাংসদ খুনের ঘটনায় তোলপাড় ফেলে দিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের সাংসদ খুনে পলাতক ৪ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিশ জারি করা হয়েছে। সিআইডি সূত্রের খবর, মূল অভিযুক্ত আখরাউজ্জামান ছাড়াও সিয়াম, মুস্তাফিজুর রহমান ও ফয়জলের বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিশ জারি হয়েছে। দেশের যে কোনও বন্দর বা বিমানবন্দরে দেখা গেলেই এদের আটক করতে নির্দেশ দিয়েছেন সিআইডি কর্তারা।
ছাত্রজীবন থেকেই বাংলাদেশের এমপি আনার স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত হয়ে পড়েন; হত্যাকাণ্ড ঘিরে নানা রহস্য-প্রশ্নের কানাঘুষা, গোয়েন্দাদের কাছে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য
এদিকে হত্যা মামলার বিচার বাংলাদেশে না ভারতে হবে -তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন
কলকাতায় খুন হওয়া বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে তার উত্থান, স্বর্ণ চোরাচালান, খুনখারাবিসহ অপরাধের বহু বিষয় উঠে আসছে। রহস্যের বেড়াজাল ঘনীভূত হচ্ছে হত্যাকাণ্ড ঘিরে। নানা প্রশ্নের উত্থান হচ্ছে৷ তবে সব প্রশ্নের ভিড়ে একটা বিষয় বাংলার অনুসন্ধিৎসু মানুষের মুখে মুখে৷ কে এই এমপি আনার? তাকে ঘিরে এত আলোচনা কেন? বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সর্বহারাদের রাজত্ব ছিল। সেই রাজত্বের মধ্যে এমপি আনারের উত্থান। তার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আকতারুজ্জামান শাহীন। আর হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নকারী শিমুল ভুঁইয়া ওরফে আমান উল্লাহ। স্থানীয় এলাকাবাসীর কাছ থেকে এবং প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তের পাশাপাশি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমপি আনার ছাত্রজীবন থেকে ২৪-২৫টা মোটরসাইকেল নিয়ে চলতেন। নিজে চালাতেন লাল রঙের একটি মোটরসাইকেল।
অন্য মোটরসাইকেলগুলোতে চোরাচালানের সামগ্রী বহন করত তার নিয়োজিত কর্মীরা যারা ছিল বেতনভুক্ত। এক জন আনারের পেছনে বসে থাকত। তার সঙ্গে চোরাচালানির মালামাল থাকত। তার প্রতিটি গাড়িতে নম্বর থাকত। ওই নম্বর দেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ছেড়ে দিত কারণ আনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রতি মাসে নির্ধারিত হারে টাকা দিতেন।
আনোয়ারুল আজিম আনারের পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায়। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি ছিলেন৷ টানা তিন বার আওয়ামী লীগ থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এলাকাবাসী জানান, একসময় দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করতেন আনার।
অস্ত্র ও বিস্ফোরকদ্রব্য পাচারের হোতা হিসেবেও পুলিশের খাতায় নাম ছিল তার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের ‘গডফাদার’ হিসেবে পরিচিতি পান। আনারের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চরমপন্থিদের আশ্রয় ও হত্যাসহ ২২টি মামলা ছিল। আনার হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত তা নিয়ে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। তাদের স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানির টাকার ভাগ অনেকে পেতেন। এই ভাগের টাকায় এমন অনেকে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন যারা প্রচণ্ড অভাবী ছিলেন, প্রায় সবার বাবা ছিলেন শ্রমিক ও দিনমজুর। তারা এখন দলীয় নেতা সেজে রয়েছেন। অনেকেই স্বীকৃত রাজাকারের সন্তান যারা ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছিলেন৷
১৯৮৪ সালে মাধ্যমিক ও ১৯৮৬ সালে এইচএসসি পাশ করেন আনার। ঝিনাইদহের সরকারি মাহতাবউদ্দিন কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করেন ১৯৮৮ সালে। বাংলাদেশের সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, সেই সময় স্বর্ণ চোরাচালান ও মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন আনার৷ এক পর্যায়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়ে যান। মাইক্রোবাসে করে ঢাকা বিমানবন্দর এলাকা থেকে স্বর্ণ নিয়ে যেতেন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় আর মাদক নিয়ে আসতেন ঢাকায়। আনারের এলাকায় তারই একক আধিপত্য ছিল। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রথমে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ পৌরসংস্থার সদস্য ছিলেন। দুই বার মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।
পশ্চিমবঙ্গের বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্তপথে চোরাচালান করতেন তিনি। ঐ সময় বাংলাদেশের ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থানাসহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ তৈরি করে তার বাহিনী। ঐ টোকেন দেখালেই প্রশাসনের লোকজন মাদকদ্রব্য বহনকারী গাড়িগুলো ছেড়ে দিত। এই টোকেন বাণিজ্য থেকে আনার বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই মাদক কারবারি করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান। ২০০৯ সালে আনার উপজেলার চেয়ারম্যান হন। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে এমপি।
আওয়ামী লীগের রাজনীতির আগে তিনি এরশাদের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় পার্টির হয়ে রাজনীতি করতেন। এরপর কিছুকাল বিএনপির রাজনীতি করেছেন৷ তার সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য বিএনপি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়৷ এরপর অর্থবিত্তের দাপটে বনে যান আওয়ামী লীগের নেতা৷
চরমপন্থি লাল দলের প্রধান বলে পরিচিত বাংলাদেশের রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র ডাক্তার টুটুলকে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) তুলে নিয়ে যায়। তুলে নেওয়ার পরদিন তার লাশ পাওয়া যায় নওগাঁয়ের গোদাগাড়ি এলাকায়। ঐ সময় তার পরিবার সন্দেহ করেছিল, এমপি আনার লাল দলের প্রধান ডাক্তার টুটুলকে র্যাবের হাতে তুলে দিতে সহযোগিতা করেছিলেন। আর ওই নিহত টুটুল হলেন এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী শাহীনের আপন চাচাতো ভাই, আর এমপি আনার হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নকারী শিমুল ভূঁইয়ার আপন ভগ্নীপতি। এ কারণে শাহীন ও শিমুল আগে থেকেই এমপি আনারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। শিমুলকে র্যাব দিয়েও মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন এমপি আনার। তবে শিমুল সে যাত্রা পালিয়ে নিজেকে বাঁচায়। শাহীন ও শিমুলের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল এমপি আনারের ওপর।
এরপর ৫০০ কোটি টাকার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব বাধে মাফিয়া চক্র ও শাহীনের সঙ্গে। কয়েক জন বড় ব্যবসায়ী ও দুইজন সাবেক এমপি এই মাফিয়া চক্রে রয়েছেন। তবে এককভাবে সব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন এমপি আনার। মাফিয়ারা শাহীনকে দিয়ে তার ফুপাতো ভাই শিমুল ভুঁইয়াকে কাজে লাগায় এমপি আনার হত্যাকাণ্ড ঘটাতে। এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের পেছনে ডাক্তার টুটুল হত্যাকাণ্ডও একটি কারণ।
ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার এমপি আনারকে আটক করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। ঐ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অপারেশনের সময় আত্মগোপনে ছিলেন আনার। ১৯৯৬ সালে আনার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালান কারবারের পাশাপাশি কালীগঞ্জ পৌরসভার এক কমিশনারের হাত ধরে অস্ত্র চোরাকারবারেও জড়ান তিনি।
তার অবৈধ অস্ত্রের চালান চরমপন্থি ক্যাডার সামসেল ওরফে রবিনের কাছে বিক্রি হতো। ২০১২ সালে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় আনার, পরিতোষসহ বেশ কয়েকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পান। ঐ মামলায় আনারকে গ্রেফতারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত। এর ১০ দিন পর ঐ বছরের ২১ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতারের জন্য নিশ্চিন্তপুর গ্রামে তার বাড়িতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তখন তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে বেশিরভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আনার। অনেকেই বলে থাকেন বাংলাদেশের ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত মাফিয়াদের কাছে যত পরিমাণ টাকার পাহাড়, তারা নিজেরাই বাজেট দিতে পারে। দেশ-বিদেশে তাদের বিপুল সম্পদ। তারাই সবকিছুর একচ্ছত্র অধিপতি৷’
এদিকে প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশের নাগরিক একজন এমপিকে ভারতে হত্যার ঘটনায় বিচার হবে কোন দেশে? কারণ হত্যা সংঘটনের স্থান কলকাতায় হলেও এর পরিকল্পনা হয় বাংলাদেশে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভুক্তভোগী, আসামি, ঘটনাস্থল এবং হত্যাকাণ্ডের মোটিভ বিবেচনায় দুই দেশেরই এই হত্যা মামলার বিচার করার এখতিয়ার রয়েছে৷ এ বিষয়ে একাধিক মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ও রয়েছে। দুই দেশেরই ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, সাধারণত অপরাধ সংঘটনের স্থানে মামলার বিচার হয়৷ তবে, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার যে ধরন তাতে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মামলার বিচার দুই দেশেই সম্ভব বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা৷ বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাপস কান্তি বল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই সুনির্দিষ্ট মামলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিচার করার দাবিটা করতে পারে। কারণ বাংলাদেশের ভিকটিম, আসামি, মেইন কজ অব একশন বাংলাদেশেই উদ্ভূত হয়েছে। শুধুমাত্র ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ভারতে। অর্থাৎ ঘটনা পরিণতি লাভ করেছে ভারতে।” সুতরাং বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবেই এই অপরাধের তদন্ত ও বিচার করতে পারবে বলে মনে করছেন তাপস কান্তি বল। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে কোনো ধরনের অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তার লক্ষ্যে রয়েছে একটি চুক্তি।
এই চুক্তির অধীনে দুই দেশই করতে পারে এই হত্যা মামলার বিচার। বাংলাদেশে ২০১২ সালে ‘মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিসটেন্স ইন ক্রিমিনাল ম্যাটারস অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এর অধীনে একটি নীতিমালাও করা হয়। এছাড়া ভারতের সাথে বাংলাদেশের এই আইনের অধীনে আন্তর্জাতিক কনভেনশনও আছে। দুই দেশই এতে স্বাক্ষর করেছে৷ একইসাথে এই কনভেনশনের অধীনে ২০১৩ সালে দুই দেশ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ওই চুক্তির ফলে ভারতের কোনো নাগরিক যদি বাংলাদেশে কোনো অপরাধ করে বা শিকার হয় সেক্ষেত্রে ভারতেও এর বিচার হতে পারে। সেক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের শারীরিক বা দালিলিক প্রমাণ, অভিযোগপত্র বা কোনো সাক্ষ্য এমনকি মৌখিক সাক্ষ্যও দেয়ার প্রয়োজন হলে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করতে পারবে৷ একইসাথে, যদি বাংলাদেশের নাগরিকরা ভারতে কোনো অপরাধ করে বা শিকার হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ মামলা করতে পারবে। এক্ষেত্রে যেসব দালিলিক বা বস্তুগত প্রমাণ আছে তা ভারতের কাছে চাইতে পারবে বাংলাদেশ। চুক্তিতে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করবে দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক৷ তাপস কান্তি বল জানান, “তদন্তকারী কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন, সেখানে সিসিটিভির ফুটেজ, বস্তুগত যেসব প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তাও বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারবে। এই চুক্তির অধীনে ভারত এসব দিতে পারবে।”
চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার প্রয়োজন হলে ভারত থেকে আসতে পারবে সাক্ষীরা। মামলার সাক্ষী হিসেবে আলামত জব্দকারী কর্মকর্তা, তদন্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই অথবা বিচারের স্বার্থে যাদের সাক্ষ্য দেয়া প্রয়োজন তারা বাংলাদেশের আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারবে। “তবে কোনো কারণে সাক্ষীরা বাংলাদেশে আসতে না পারলে ভার্চুয়ালিও সাক্ষ্য নেয়া যাবে। কারণ এখন বাংলাদেশ এভিডেন্স অ্যাক্ট পরিমার্জন করে ডিজিটালিও সাক্ষ্য নিচ্ছে।
ফলে অনলাইনেও সাক্ষ্য নেয়া যাবে,” যোগ করেন তাপস কান্তি বল। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কলকাতা ও ঢাকা দুই স্থানেই মামলা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশেই দুই-তিন মাস আগে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী শাহীন এ হত্যার পরিকল্পনা করে। যেহেতু এমপি আনার কলকাতায় যাবেন তাই সেখানেই খুন করার পরিকল্পনা করা হয়। এই শাহীন মার্কিন নাগরিক এবং একইসাথে এমপি আনারের ব্যবসায়িক অংশীদার বলে জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের এই পুলিশকর্তা৷
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দুই দেশে দুই ধরনের অপরাধের বিচার করলে আসামিদের শাস্তির আওতায় আনা সহজ হবে। যদি মূল পরিকল্পনাকারী যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায় তাহলে বাংলাদেশ তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কারণ আমাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। কিন্তু ভারত তাকে সে দেশে ফেরাতে পারবে। ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে৷” এর আগে কলকাতা হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ ফৌজদারি আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চ্যাটার্জী বলেছিলেন, “অপরাধ যেহেতু ভারতে হয়েছে, তাই ভারতের আইন অনুযায়ীই বিচার হওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে বিচারটা কোন দেশে হবে, তা দু’দেশের মধ্যে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷”