বাংলাদেশ ও ভারতের রেল ট্রানজিট চুক্তির মধ্যে দিয়ে ট্রান্স এশিয়ান নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের রেলওয়ে। এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহার করে ভারত যেমন নিজেদের ভূখণ্ডে যেতে পারবে তেমনি বাংলাদেশ রেলওয়ে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে যেতে পারবে নেপাল ও ভুটানে।
প্রস্তাবিত চুক্তিতে ১২টি রুটের কথা বলা হয়েছে, যেসব রুট ব্যবহার করে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ‘সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত সাত রাজ্যে যোগাযোগ সহজ হবে। এক্ষেত্রে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল-ভুটানে যেতে পারা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। ২৬ জুন বুধবার সেই ধোঁয়াশা দূর করলেন বাংলাদেশের রেলপথ সচিব হুমায়ুন কবির ও বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী। গণমাধ্যমে দুজনই জানালেন, নতুন সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্যে উন্মুক্ত হচ্ছে ভারতীয় রেলপথ দিয়ে নেপাল-ভুটান প্রবেশের দ্বার। নেপাল ও ভুটান যথাক্রমে ১৯৭৬ ও ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি করেছিল। কিন্তু ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের মালবাহী গাড়ি চলাচল করতে না পারায় সেটি খুব একটা কার্যকর হয়নি। এখন ভারতের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার কারণে নতুন করে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে পূর্বে হওয়া সেই চুক্তি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা জেগেছে।
গত ২২ জুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১৩টি ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার এক নম্বরে রয়েছে রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে নতুন ট্রেন সার্ভিস চালুকরণ, ভারতীয় রেল করিডোর নিয়ে নয়া চুক্তি। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৭৭ বছর পর রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে পুনরায় ট্রেন সার্ভিস চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। যেটি হবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলাচলকারী চতুর্থ আন্তঃদেশীয় ট্রেন। এছাড়া এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে কলকাতা থেকে ‘সেভেন সিস্টার্স’-খ্যাত সাত রাজ্যের ১২টি রুটে পণ্য ও যাত্রী চলাচলের সুবিধা। নতুন পরিকল্পনার আওতায় মোট এক হাজার ২৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের ১৪টি সেকশন থাকবে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে থাকবে ৮৬১ কিলোমিটার। আর নেপালে ২০২ কিলোমিটার ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকবে ২১২ কিলোমিটার পথ৷ বাংলাদেশ সরকার দেশের ভেতরে ভারতকে রেলপথ স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নয়াদিল্লির পরিকল্পনা সহজ হয়েছে। রেলওয়ে সূত্রে খবর, বাংলাদেশে মোট ৮৬১ কিলোমিটার, নেপালে ২০২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এবং উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জরিপ চালানো হবে। ভারতের সঙ্গে এই চুক্তির ফলে ভারতের মাটি ব্যবহার করে বাংলাদেশ রেলওয়ে নেপালেও পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
প্রস্তাব অনুসারে, ভারত ও নেপালের মধ্যে রেল সংযোগের জন্য অনুমোদিত রুট বিরাটনগর–নিউ মাল জং সেকশনে ১৯০ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণের প্রয়োজন হবে৷ আর গালগালিয়া-ভদ্রপুর-কাজলী বাজার সেকশনে সাড়ে ১২ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণের প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে ভুটানে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের রেলপথ ব্যবহার করে দেশটির সীমান্তবর্তী হাসিমারা স্টেশন যাওয়া যাবে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যে রেল সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে যোগাযোগের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে চায় তা আদতে একটি ‘ওপেন ডোর’ পলিসি। এ সম্পর্ক উন্নয়নের মূল কথা হলো, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের সুযোগ দেওয়া। কেউ এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে যাবে, এ নীতিতে আসলে উন্নয়ন স্থিতিশীল হয় না। আঞ্চলিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি চমৎকার ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে। আমাদের কোস্ট লাইন বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো বহুমাত্রিক।’
বাংলাদেশ রেলপথ মন্ত্রকের সচিব হুমায়ুন কবির জানান, ‘যখন বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশান), ট্রান্স এশিয়ান নেটওয়ার্ক আর বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল নিয়ে উপ আঞ্চলিক সংযুক্তি-বিবিআইএন নিয়ে কথা বলছি, সেই নেটওয়ার্ক বা রুট কিন্তু কেবল একটি দেশের রুট ব্যবহার করে বাস্তবায়ন সম্ভব না। আমরা চুক্তি বাস্তবায়নের সময় বলছি, ভারতের ট্রেনটি গেদে স্টেশন থেকে দর্শনা, আব্দুলপুর, চিলাহাটি হয়ে হলদিবাড়ি, ডালগাঁও পর্যন্ত যাবে। পরে আমাদের অনুরোধে পশ্চিমবঙ্গের আলিদুয়ারপুর জেলার হাসিমারা সীমান্ত পর্যন্ত রেল চালানোর অনুমতি মিলেছে। এতে আমরা ভুটান সীমান্তের কাছাকাছি যেতে পারব। ’
ভারতের সঙ্গে যে ১২টি রেলপথে আন্তঃদেশীয় সংযোগ স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে রেলওয়ে তাতে নজর রাখছে বিরল-রাধিকাপুর এবং মোগলহাট-গিতলদহ রুটে। রেলপথ সচিব বললেন, ‘বিরল-রাধিকাপুর হয়ে ভারতের যোগবাণী পর্যন্ত রেল চলবে। সেখান থেকে নেপালের বিরাটনগর সীমান্ত কাছে। নেপালের পাথর এ রুটে আসছে বাংলাদেশে। এই পথে যদি পণ্যবাহী রেল আমরা পরিচালনা করতে পারি, তবে বাংলাদেশ রাজস্ব আরও বেশি আয় করবে। চুক্তি অনুযায়ী আমরা ভারতের বর্তমান রেলপথ ব্যবহার করতে পারব। ’
এখন প্রশ্ন উঠেছে, ১২টি রেলপথে আন্তদেশীয় সংযোগ স্থাপন করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কীভাবে হবে? এ প্রশ্নে রেলওয়ে মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী জানালেন, ‘দুই দেশের একটা কমিটি হবে। এখন স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) তৈরি করতে হবে। ট্যারিফ প্ল্যান করতে হবে। সবে তো চুক্তি হল। কারা কীভাবে অর্থ লগ্নি করবে সেটি আসবে তারপর। ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট দু’ধরনের পলিসির কথাই চুক্তিতে আছে। এখন নেপাল, ভুটানে কীভাবে পণ্য যাবে, কীভাবে আমরা লভ্যাংশ পাব সেটি নির্ধারণ করবে কমিটি। এতে কোনো এক দেশ এককভাবে লাভবান হবে এমন কোনো কথা নেই।’