দেশের সময়: গত পঞ্চায়েত ভোটে বাগদার একাধিক জায়গায় রক্তগঙ্গা বয়ে গিয়েছিল। জ্বলেছিল আগুন। বহু মানুষ জখম হয়েছিলেন। একচেটিয়া পঞ্চায়েত দখলে এই তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় তৃণমূলের ইমেজ অনেকটাই খারাপ হয়েছে। তারপর ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্ব দলের অনেককেই ব্যাকফুটে পাঠিয়ে দেয়। মূলত বনগাঁ শহরের এক নেতা, যাঁর নির্দেশে তৃণমূল বাহিনী ভোটের দিন বাগদায় ওই তাণ্ডব চালিয়েছিল বলে অভিযোগ, তাঁকে কোণঠাসা করে দেওয়া হয়। অনেক চেষ্টার পরও সেই নেতা দলের মূল সারিতে আর ফিরতে পারেননি। কিন্তু তা বলে বাগদায় তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল বন্ধ হয়নি। বরং তা দিনদিন বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আবারও পঞ্চায়েত ভোট দোরগোড়ায়। ফলে রাজনৈতিক মহলে যেমন তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনই বাগদার মানুষের মনে ভেসে উঠছে পাঁচ বছর আগের স্মৃতি। আবারও কি ভোট ঘিরে রক্তাক্ত হবে বাগদা? এই প্রশ্ন তাড়া করে ফিরছে বাগদাবাসীকে। 

এদিকে, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব সামাল দিয়ে সুষ্ঠুভাবে ভোট করানো এবং দলকে নিরঙ্কুশ জয় এনে দেওয়া চ্যালেঞ্জ তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ দাসের কাছে। কারণ, তিনি নিজেই বাগদার বিধায়ক। যদিও বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন তিনি। কিন্তু আগাগোড়া তৃণমূলের সংসারেই রয়েছেন বিশ্বজিৎ। ফলে দলের কোথায়, কোন নেতার কী ভূমিকা তা তাঁর বেশ ভালমতোই জানা। ফলে বাগদায় এবারের পঞ্চায়েত ভোট বিশ্বজিতের কাছে রীতিমতো অগ্নিপরীক্ষা।

এরই মধ্যে বাগদার প্রাক্তন বিধায়ক দুলাল বরের ভূমিকা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছে। তৃণমূলের হাত ধরেই তাঁর রাজনীতিতে উত্থান। কিন্তু ঘন ঘন শিবির বদল করেছেন তিনি। কখনও বিধানসভায় টিকিট না পেয়ে কংগ্রেস-সিপিএম জোটের প্রার্থী হয়েছেন দুলাল বর। কখনও আবার যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। এখনও দুলালবাবু বিজেপিতেই রয়েছেন বলে দাবি করলেও তাঁর কথাবার্তা বেসুরো শুনিয়েছে। আর এই ঘোরালো রাজনৈতিক সমীকরণের মাঝেই তৃণমূলের একাংশ বলতে শুরু করেছে, দুলাল বর তৃণমূলের সঙ্গেই আছেন। সময় হলেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ্যে আনবেন। যদিও তিনি যে তৃণমূলের সঙ্গে আছেন তা সরাসরি মানতে চাননি দুলালবাবু।   

তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ দাস জানিয়েছেন, এটুকু বলতে পারি, এখন বাগদাতে দলের অন্দরে কোনও গোষ্ঠী কোন্দল নেই। সবাইকে নিয়ে দলীয় কর্মসূচি করা হচ্ছে। বাগদার মানুষ সুষ্ঠুভাবে পঞ্চায়েত ভোট দিতে পারবেন, এটুকু আশ্বাস দিতে পারি। 

বিরোধীরা কতটা মাথাব্যথার কারণ হতে পারে? বিশ্বজিতের দাবি, বিরোধী বলে কিছু নেই। যারা তথাকথিত বিরোধী তারা ইডি, সিবিআইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমরা মানুষের সঙ্গে আছি। বাগদার মানুষ স্বাধীনতার পর থেকে এতদিন কোনও উন্নয়নের স্বাদ পায়নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এখন বাগদাবাসী উন্নয়ন চাক্ষুস করতে পারছেন। বাগদা হাসপাতালে সিজার শুরু হয়েছে। এলাকার মানুষের এটা দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। হেলেঞ্চা, সিন্দ্রাণী সহ বাগদা ব্লকের বিভিন্ন বড় বাজারে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে সিসি টিভি লাগানো হয়েছে। পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পঞ্চায়েতের আগেই বেশ কিছু রাস্তা হয়ে যাবে। কয়েকটি সেতুর প্রস্তাবও রয়েছে। সেগুলিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ট্যাংরা সুন্দরপুরে বেহাল রাস্তা নিয়ে এলাকার মানুষ আন্দোলন করছিলেন। বিধায়ক তহবিলের অর্থ দিয়ে সেই রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। 

গত পঞ্চায়েত ভোটে আষাঢ়ু, হেলেঞ্চা, আমডোব, কোনিয়াড়া সহ বিভিন্ন জায়গায় রক্তগঙ্গা বয়ে গিয়েছিল। এবারও কি তার পুনরাবৃত্তি হবে? বিশ্বজিতের বক্তব্য, গত ভোটে কিছু জায়গায় অশান্তি হয়েছিল এটা ঠিক। কিন্তু আমরা কোনও গোলমাল চাই না। মানুষের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে। আমরা চাই, মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিন। তৃণমূলই জিতবে। 

প্রসঙ্গত, বাগদা ব্লকে মোট ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। গত ভোটে সাতটিতে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। যদিও পরে অধরা থাকা দু’টি পঞ্চায়েতও তৃণমূলের দখলে চলে আসে। একচেটিয়া শাসন করতে শুরু করে জোড়াফুল শিবির। পঞ্চায়েত ভোটের হাওয়া গরম হতেই বাগদার বিভিন্ন এলাকায় দুর্নীতির অভিযোগও উঠতে শুরু করেছে। সামনে আসছে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটরাজের রমরমা। সরকারি বাড়ি পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও মোটা টাকা কাটমানি নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। সাধারণ মানুষ তো বটেই, তৃণমূলের বিরুদ্ধে এই দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন বাগদার প্রাক্তন বিধায়ক দুলাল বর। 

অভিযোগ, বাগদায় পঞ্চায়েতে তৃণমূলের প্রার্থী হওয়া নিয়ে এখন থেকেই লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। কোন শিবিরের কাকে প্রার্থী করা হবে, তা নিয়ে চর্চা তুঙ্গে। পরিস্থিতি এমনই যে, তৃণমূলের প্রার্থী হতে না পারলে, গোঁজ হয়ে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন অনেক নেতা-কর্মীই। ফলে বাগদায় পঞ্চায়েত ভোট তৃণমূলের কাছে যে খুব একটা মসৃণ হতে চলেছে, তা মোটেই নয় বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। বিশ্বজিৎ দাস অবশ্য জানিয়েছেন, পঞ্চায়েতের প্রার্থী বাছাই করবেন বুথ স্তরের কর্মীরা। বুথে মিটিং ডেকে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন, আগামী পাঁচ বছরের জন্য কাকে তাঁরা নিজের এলাকায় প্রার্থী চাইছেন। দল তাঁকেই টিকিট দেবে। এর বাইরে কোনও নেতার সুপারিশ মানা হবে না। 

কেমন হবে বাগদায় পঞ্চায়েত ভোট? দুলাল বর বলছেন, এটুকু বলতে পারি, অবাধ ভোট হলে তৃণমূল মুছে যাবে। তৃণমূলের নেতাদের দেখলে মানুষ ভয় পায়। এমন একজন নেতাও নেই যে, মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়নি। 

আমি বিধায়ক কোটা থেকে বাগদা পঞ্চায়েত সমিতিকে উন্নয়নের জন্য এক কোটি টাকা দিয়েছিলাম। সেখান থেকেও ১০ শতাংশ কাটমানি নিয়ে তবেই ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। একজন বিধায়কের ফান্ড থেকেও যদি কাটমানি খাওয়া হয়, তা হলে বোঝাই যায়, কী চলছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে আপনার ভূমিকা কী হবে? বিজেপির হয়ে মাঠে নামতে দেখা যাবে? দুলালবাবুর উত্তর, বিজেপি অন্য ধারার পার্টি। যাঁকে যা দায়িত্ব দেয় দল, তার বাইরে কেউ কোনও কাজ করতে পারেন না। আমাকে দলের তরফে নদীয়ায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি ওখানেই সাংগঠনিক কাজ করছি। বাগদাতে সেজে সিঁদুর পরতে যাব না। বিজেপিতে কি খানিকটা কোণঠাসা? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে দুলাল বরের বক্তব্য,আমি আমার মতো আছি। বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য। স্বচ্ছ ভারত কমিটিতে রয়েছি। বাগদায় দায়িত্ব দেয়নি পার্টি। কী করা যাবে। আগ বাড়িয়ে কোনও কর্মসূচি নিতে গেলে পুলিসের সঙ্গে অযথা ঝামেলায় জড়াতে হবে। এতে বিপদ বাড়বে। পার্টির কর্মীদেরও বলেছি, পঞ্চায়েত ভোটের আগে কেউ যেন পুলিসের সঙ্গে ঝামেলায় না জড়ায়। 

বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সাধারণ সম্পাদক দেবদাস মণ্ডল জানিয়েছেন, দলে যাঁর যেটুকু অভিমান রয়েছে, পঞ্চায়েত ভোটের আগে তা মিটে যাবে। ২০১৮ সালে শুধু বাগদায় নয়, গোটা বাংলায় তৃণমূল ভোট লুট করেছে। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, সেদিনের বিজেপি আর আজকের বিজেপি এক নয়। তৃণমূলের গুণ্ডা বাহিনী ভোট লুটের চেষ্টা করলে মানুষই গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করবে। এটা বলতে পারি, এবার তৃণমূলের চোখে চোখ রেখে ভোটে লড়বে বিজেপি। প্রতিটি পঞ্চায়েতেই বিজেপির ভাল ফল হবে। 

সিপিএমের বনগাঁ শহর এরিয়া কমিটির সদস্য পীযূষ সাহা বলেছেন, গতবারও বাগদায় তৃণমূলের ভোট লুট সাধারণ মানুষই রুখে দিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, এবার আরও বেশি শক্তি দিয়ে মানুষ ভোট লুটের চেষ্টা রুখে দেবে। বামেরা কি আদৌও পঞ্চায়েতে দাগ ফোটাতে পারবে? পীযূষবাবুর কথায়, আমাদের সাংগঠনিক কাজকর্ম চলছে। পার্টির যা সিদ্ধান্ত, সেইমতো প্রার্থী নির্বাচন হবে পঞ্চায়েতে। নতুনদের তুলে আনা হবে। আবার প্রবীণদেরও সঙ্গে নিয়ে চলা হবে। নবীন-প্রবীণের এই মেলবন্ধনে পঞ্চায়েতে আমরা ঘুরে দাঁড়াব, এই বিশ্বাস রয়েছে আমাদের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here