বাগদা : বুধবার বিকালে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হলো বাগদা বিধানসভার উপনির্বাচনের ভোটদান পর্ব । দেখুন ভিডিও
এই কেন্দ্রে এ বার লড়াই তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে।২০২১ সালে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির টিকিটে বাগদার বিধায়ক হয়েছিলেন বিশ্বজিৎ দাস। লোকসভায় বনগাঁ কেন্দ্রে তৃণমূলের টিকিট পাওয়ার পর তিনি বিধায়ক পদে ইস্তফা দেওয়ায় উপনির্বাচন হচ্ছে বাগদায়।
লোকসভা ভোটে শিকে ছেঁড়েনি বিশ্বজিতের। বনগাঁয় দ্বিতীয়বারের জন্য জিতে সাংসদ হয়েছেন বিজেপির শান্তনু ঠাকুর। রাজ্যজুড়ে তৃণমূল ভালো ফল করলেও বাগদায় বিজেপির থেকে অনেকটা পিছিয়ে থাকায় চিন্তার বহর বেড়েছে শাসক শিবিরে। ভোটের আগে গত কয়েক দিন ধরে বাগদা চষে বেড়িয়েছেন তৃণমূলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা-মন্ত্রী সুব্রত বক্সী, রথীন ঘোষ, পার্থ ভৌমিক, নারায়ণ গোস্বামী, মমতাবালা ঠাকুর এবং বিশ্বজিৎ দাসরা।
অন্যদিকে, জয়ের ধারা বজায় রাখতে মরিয়া গেরুয়া শিবিরও। কিন্তু দলের ‘বহিরাগত’ প্রার্থী বিনয় বিশ্বাসকে মেনে না নিয়ে বিজেপির বিক্ষুব্ধ শিবির নির্দল প্রার্থী দেওয়ায় অস্বস্তি বেড়েছে পদ্ম শিবিরে।
উত্তর ২৪ পরগনার একেবারে সীমান্ত লাগোয়া বাগদা বাম জমানায় ফরোয়ার্ড ব্লকের দখলে ছিল। ২০১১ সালে বাগদা থেকে তৃণমূলের বিধায়ক ছিলেন উপেন বিশ্বাস। ২০১৬ সালে বাম-কংগ্রেসের জোটের বিধায়ক হয়েছিলেন দুলাল বর। তিনি অবশ্য পরে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর ২০২১ সালে এই কেন্দ্রে বিজেপির বিধায়ক হন বিশ্বজিৎ দাস।
তিনিও পরে তৃণমূলে ফিরে আসেন। বারবার বিধায়ক পরিবর্তন হলেও বাগদার উন্নয়ন সে ভাবে হয়নি। ফলে না পাওয়ার ক্ষোভে ২০১৯ এবং সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে বাগদার মানুষ দলবদলুদের থেকে মুখ ফিরিয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বাগদা ব্লকের ১২টি পঞ্চায়েতের মধ্যে তিনটি পঞ্চায়েত বিজেপি দখল করে। উপনির্বাচনে বাগদা পুনরুদ্ধারে ঠাকুরবাড়ির প্রতিনিধি মধুপর্ণাকে প্রার্থী করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বনগাঁ লোকসভার অধীনে বাগদা বিধানসভা কেন্দ্রেই মতুয়া ভোটারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মতুয়া, নমশূদ্র মিলিয়ে প্রায় ৬৩%। তফসিলি ভোটার রয়েছে প্রায় ১২%। লোকসভা ভোটে সংখ্যালঘু ভোট শাসকদলের পাশে থাকলেও মুখ ফিরিয়েছেন মতুয়া ও নমশূদ্ররা। মতুয়া অধ্যুষিত বাগদা বিধানসভায় রয়েছেন ৩৮৫ জন দলপতি। পাগল, গোঁসাইদের নিয়ে এই দলপতিরাই মতুয়াদের পরিচালনা করেন।
দলপতিদের একটা বড় অংশ তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও অনেকেই রয়েছেন বিজেপি শিবিরে। সদ্য সমাপ্ত লোকসভায় তৃণমূলের প্রার্থী অ-মতুয়া বিশ্বজিৎ দাসের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বাগদার মতুয়া ভোটাররা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দলপতি বলেন, ‘প্রার্থী হিসেবে বিশ্বজিৎ দাসকে মতুয়ারা মেনে নিতে পারেননি।’
রাজনৈতিক মহলের ধারণা, ঠাকুরবাড়ির প্রতিনিধি এবং তৃণমূলের প্রার্থী মধুপর্ণা নতুন মুখ হওয়ায় মতুয়াদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বাগদা কেন্দ্রে বিজেপির বিক্ষুব্ধ নির্দল প্রার্থীদের ভোট কাটাকুটি এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী গৌর বিশ্বাসের সমর্থনে সিপিএমের ভোট ফিরে এলে আখেরে উপনির্বাচনে জয় লাভ করতে পারে তৃণমূল।
বাগদায় এ বার বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া আটকাতে প্রথম থেকেই মরিয়া ছিল শাসকদল তা ভোট প্রচারেই দেখা মিলেছে। রাজ্যের মধ্যে বয়সে সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী হিসেবে বাগদায় তৃণমূলের হয়ে লড়ছেন ঠাকুরবাড়ির সদস্য, শান্তনু ঠাকুরের জ্যেঠতুতো বোন প্রার্থী মধুপর্ণা ঠাকুর ।আর প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণার পর থেকেই ‘কনফিডেন্ট’ দেখিয়েছে মধুপর্ণাকে। গোটা প্রচার পর্বের পাশাপাশি ভোটের দিনও আত্মবিশ্বাসে কোনওরকম খামতি নেই তাঁর।
ভেটের দিন সকাল থেকেই বাগদা বিধানসভার বিভিন্ন বুথে ঘুরতে দেখা যায় মধুপর্ণা ঠাকুরকে। মা মমতাবালা ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়েই বাড়ি থেকে বের হন তিনি। তবে সকালে মা মমতাবালা ঠাকুরের সঙ্গে ‘গভঃ অফ ইন্ডিয়া’ লেখা গাড়িতে চড়ে বেরনোয় তৈরি হয় বিতর্ক। বিষয়টি নিয়ে বিজেপির তরফ থেকে অভিযোগ জানানো হয় কমিশনে। যদিও সাময়িকভাবে সেই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বাগদা বিধানসভা এলাকার নানা বুথ পরিদর্শন জারি রাখেন মধুপর্ণা। প্রার্থীর পরিচয়পত্র নিয়ে বিভিন্ন বুথে প্রবেশ করে ভোট পরিদর্শন করেন তিনি। আর গাড়িতে বসে থাকেন মা মমতাবালা। কোনও কোনও জায়গায় ভোটারদের সঙ্গে কথাও বলেন তিনি। আবারবাগদা বিধানসভা এলাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা অভিযোগ পেয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থাও নিতে দেখা যায় তৃণমূল প্রার্থীকে।
একটা সময় নলডুগারি এফপি স্কুলের ৩০,৩১ ও ৩২ নম্বর বুথে বিজেপির ঝান্ডা বেঁধে টোটো করে ভোটারদের নিয়ে আসার অভিযোগ ওঠে। ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়ায় এলাকায়। এরপরই তৎপর হতে দেখা যায় তৃণমূল প্রার্থী সহ কর্মী ও সমর্থকদের। নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানান হয়। তারপরই টোটো থেকে ঝান্ডা খুলে দিতে দেখা যায়। এককথায় বলতে গেলে এভাবেই বাগদা বিধানসভার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত কখনও সশরীরে, কখনও আবার ফোনে নির্দেশ দিয়ে ভোট পরিচালনা করলেন মধুপর্ণা।
দিনভর ছোটাছুটির পরেও ক্লান্তির লেশমাত্র দেখা যায়নি মধুপর্ণার চোখেমুখে। বরং এদিনও জয়ের বিষয়ে একইরকম আত্মবিশ্বাসী দেখিয়েছে তাঁকে।
দেশের সময় কে এদিন মধুপর্ণা বলেন, ‘প্রথমদিন থেকেই বলছি, জয়ের আবির এবার আমরাই খেলব। বুথে বুথে দেখেছি। সব জায়গাতেই ইতিবাচক সাড়া, যা হচ্ছে ভালোই হবে।’ এই উপনির্বাচনে বাগদায় বিজেপির কোনও স্থান নেই বলেই মনে করেন তৃণমূল প্রার্থী।
অন্যদিকে, বিজেপির ‘বহিরাগত’ প্রার্থী বিনয় বিশ্বাস , এই অভিযোগ সামলে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে মরিয়া গেরুয়া শিবিরও ।
উল্লেখ্য, লোকসভা নির্বাচনের আগেই দেশে লাগু হয়েছে সিএএ। আর সিএএ লাগু হওয়ার পরেই মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে ভোটারদের একটা অংশের মধ্যে বেশ উচ্ছ্বাস দেখা দেয়। এমনকী এবারের লোকসভা নির্বাচনে বনগাঁ কেন্দ্রে বিজেপির জয়ের নেপথ্যেও সিএএ-র একটা ভূমিকা থাকতে পারে বলে অনুমান রাজনৈতিকমহলের একাংশের। বাগদার রং বদলে এবার সবুজ হবে নাকি গেরুয়াই থাকবে এখন এটাই বড় প্রশ্ন!
সেক্ষেত্রে এখন দেখার বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই বাগদা বিধানসভায় কাকে আশীর্বাদ দেন ভোটাররা।