অরিন্দম গাঙ্গুলির কাছে দুর্গাপুজো হল এমন এক উৎসব যেখানে মানুষ সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠে জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই আনন্দে মেতে ওঠে…
” দুর্গাপুজো নিয়ে আমি ছোটবেলা থেকেই খুব নস্টালজিক। আজও পুজো এলে আমার অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। কারন ছোট থেকে যে পুজো দেখে আমি বড় হয়েছি সেই স্মৃতি এখনও পুজো এলেই আমার মধ্যে ভীষণ ভাবে নাড়া দেয়। পুজোর সময়টা তাই ছোটবেলার সেই বিশেষ স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াই।
আমি উত্তর কলকাতার ছেলে। আমাদের পাড়ার পুজো ছিল ‘ জগৎ মুখার্জী পার্ক’ -এর পুজো। এই পুজোটি এখন বেশ নাম করেছে। ছোটবেলা থেকে এই পুজো দেখেই বড় হয়ে উঠেছি। অত বছর আগেও এই পুজোর অদ্ভুত একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। এখন যেমন আমরা বিভিন্ন থিমের পুজো দেখতে পাই, তখন ‘জগৎ মুখার্জী পার্ক’- এ ও থিমের পুজো হত। এটা সত্যিই খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার ছিল। আশোক বসু নামে একজন চিত্রকর সেই প্রতিমা তৈরি করতেন, যা সে সময়কার সব প্রতিমার থেকে একেবারেই ভিন্ন মাত্রার হত। যেটাকে আমরা আর্টের ঠাকুর বলতাম। প্রত্যেক বছরই আলাদা আলাদা থিমের ওপর প্রতিমা তৈরি হত।
‘জগৎ মুখার্জী পার্ক ‘- এর প্রতিমা তৈরি হত পার্কের পাশের একটি গলিতে। যখন থেকে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হত তখন থেকেই আমার পুজো শুরু হয়ে যেত। তবে দশমীর সেই মন খারাপের অনুভূতি আজও আমার মনকে ভারাক্রান্ত করে। এই পুজোর বিসর্জনেরও একটা আলাদা বিশেষত্ব ছিল। বিসর্জনের পদযাত্রায় ছেলেদের পরনে থাকত ধুতি – পাঞ্জাবি এবং মেয়েদের লালপেড়ে শাড়ি। সকলে একসঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে মাকে বিদায় জানানোর জন্য এগিয়ে যেত। এই পরিবেশেই আমার বেড়ে ওঠা। তাই পুজোর ব্যাপারে আমি খুব স্মৃতিবেদনাতুর।
সে সময় আমাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা খুব বেশি ছিল না, তাই আমরা পুজোর সময় ময়দান মার্কেটের হকার্স কর্নার থেকে পুজোর জন্য জামাকাপড় কিনতাম। তারপর কুলপি এবং অনাদির মোগলাই পরোটা খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। ছোটবেলার সেই আনন্দই ছিল অন্যরকম। আজকাল আর প্যান্ডেল ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা হয় না, নানারকম অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয় বলে। তবে পুজো পরিক্রমার বিচারক হিসেবে যখন যাই তখন কিছু ঠাকুর দেখা হয়ে যায়।
পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে না পারলেও কলকাতার বাইরে যেতে একেবারেই মন চায় না। পুজোর যে উৎসবমুখর পরিবেশ এটা আমায় খুব টানে। এই সময় মানুষের কোলাহল, ছোট ছোট বাচ্চাদের নতুন জামা পড়ে খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠা – এ সবের মধ্যেই একটা আলাদা আনন্দ খুঁজে পাই।
দুর্গাপুজোকেই আমরা শুধুমাত্র পুজো বলি কারন এই পুজো হল একটা উৎসব। এটা এমন একটা উৎসব যেখানে মানুষ সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠে জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই আনন্দে মেতে ওঠে। তাই দুর্গাপুজো হল একটা বড় দৃষ্টান্ত যে কিভাবে ধর্ম নিরপেক্ষতা বজায় রাখা যায়। এই সব কিছু মিলিয়েই দুর্গাপুজো আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি পুজো।”