Aravalli আরাবল্লির পথে সূর্য একটা পাহাড়ের পিছনে গিয়ে ডুবলো, তারপর…

0
35

আমি জলের নিচে নগ্ন হয়ে দাঁড়াই। বাইরে এক পৃথিবী নির্জনতা

জয়দীপ রায় , দেশের সময়

যেদিন কাজ মিটে যায় আমি ফোন করে দিই একটা নাম্বারে। কাজ মিটে গেছে। এবারে গাড়ি পাঠাও। ওরা গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। কোনওবার কেলওয়াড়া লেকের পাশ থেকে তোলে, কোনওবার দেসুরি নাল পেরিয়ে গোমতি চৌরাহা অব্দি চলে আসে। এবারে উঠলাম কেলওয়াড়া লেকের পাশে চায়ের দোকানের সামনে থেকে। আমি ভাড়া গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রিজর্ট থেকে পাঠানো গাড়িতে গিয়ে উঠে মাঝের সিটে বসলাম। একটা অলিভ রংয়ের বোলেরো। লাগেজ ওরাই উঠিয়ে নিল। গাড়ি ছাড়ার আগে পাশের জন স্যার, প্লীজ ডোন্ট মাইন্ড, বলে আমার চশমাটা খুলে একটা পুরো ঢাকা দেওয়া কালো গগলস্ পরিয়ে দিল। সব ব্ল্যাক আঊট। বাইরের কিচ্ছু দেখা যাবে না আর। গাড়ি চলছে। আমি আগেও এসেছি বলে ভয় পাচ্ছি না।

গাড়ি প্রায় একঘন্টা পাহাড়ি রাস্তায় চলল। কুড়ি কিলোমিটার মত হবে। বেলা পড়ে এসেছে। মার্চের শেষেও বিকেল বিকেল ঠান্ডা পড়ে যায় আরাবল্লির অন্দরে। পাশের লোকটি এবারে চোখ খুলে দিল আমার। প্রথম কিছুক্ষণ তাকাতেই পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল এত আলো। তারপরে চোখ জুড়িয়ে আসলে দেখলাম পলাশের লাল ছোপে পুরো পাহাড় সেজে উঠেছে। পলাশ তাহলে শুধুমাত্র ছোটনাগপুরেই না, সুদূর আরাবল্লিতেও ফোটে! পুরো পাহাড় লাল হয়ে। ফোনটা পকেট থেকে বের করলাম। এতক্ষণ ফোনে হাত দিইনি। অসুবিধা হয়নি। কিন্তু, অসুবিধা হয়। ফোনটা হাতে না থাকলে হাত আশেপাশে হাতড়ায়। ঠিক পেয়েও যায়। যেন শরীরের কোনও ডিটাচেবল পার্ট। আবার কানেক্ট হয়ে যায় চলমান বিশ্বের সঙ্গে।

ফোনে টাওয়ার নেই। নেটও নেই। কি মজা! আমার ঘাড়ের আশপাশের স্নায়ুগুলো কিরকম রিল্যাক্স হয়ে গেল। হোয়াটস্ অ্যাপ নেই। ফেসবুক নেই। ট্রাম্প জেলেনেস্কি পুটিন সব দূর হয়েছে। আমি পলাশের ছবি তুলতে তুলতে যেতে লাগলাম। হঠাৎকরে একটা পাহাড়ের মাথায় একটা টেবল টপে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলো। সানসেট হবে এখানে। সন্ধ্যে ছটা চল্লিশ। মারকাটারি রং ঢালতে ঢালতে সূর্য একটা পাহাড়ের পিছনে গিয়ে ডুবলো। আমার এবারের কটেজটা পড়েছে ঝোরার জল যেখানে ছোট বাঁধ দিয়ে আটকানো হয়েছে, ঠিক তার সামনে। জলের ওপারে পাহাড়ের গোড়ায় কয়েকটা পলাশ গাছ। জলের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে তার রাজকীয় প্রতিবিম্ব। ঝোরার পাশ দিয়ে পাহাড় উঠে এসেছে। তার গায়ে গায়ে কটেজগুলো তৈরি হয়েছে। একটার সঙ্গে আর একটার অনেকটা ডিসট্যান্স। যেরকম মানুষে মানুষে থাকে। কেউ কাউকে শুনতে চায় না। ঝোরায় জল চল |ছে না। পাহাড় এখন শুকনো। পতঝরের সময়। কিন্তু পাখি ডাকছে নানান। ব্যাং ডাকছে, ঝিঁঝিঁ ডাকছে। আরও কিসব যেন ডাকছে। প্রতি আধঘন্টা একঘন্টা পরে যে একটা গাড়ি যাচ্ছে সামনের রাস্তা দিয়ে, তার যাবার শব্দ ছাড়া মানুষের তৈরী দ্বিতীয় কোনও শব্দ নেই এখানে।

যত সময় যাচ্ছে আমার নিজেকে তত হাল্কা লাগছে। মনে হচ্ছে যেন অ্যান্টি ভেনাম পড়েছে। এবার বিষ নামবে আস্তে আস্তে। পাহাড়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে বসন্তের। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে শিরশির করে সামনের পাহাড় পেরিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। আমি মাঝেমধ্যেই মোবাইলটা উঠিয়ে নিচ্ছি। অভ্যাসবশতঃ হোয়াটস্ অ্যাপ ফেসবুক চেক করছি। ফেসবুক খুলছে না। হোয়াটস্ অ্যাপে লাস্ট মোহনদা একটা গান পাঠিয়েছিল। দু’ঘন্টা আগে। ঘরে কোনও টিভি নেই। খবর নেই। জ্বালাময়ী মুখোমুখি নেই।

আইপিএলের পয়সার ঝনাৎ নেই। আজ কেউ ডিজে বাজিয়ে মদ খেয়ে নাচ করছে না। সারা পৃথিবী যেন মহুয়া খেয়ে ঝিম মেরে রয়েছে। কথা বলছে না কোনও, যদি নেশা কেটে যায়! ঘরের সামনে বটগাছ। ঝুরিগুলো শেপ করে নেওয়া, যাতে ব্যালকনির ভিউ কমে না যায়। এখানে বহুরকম গাছ আছে। কামিনী, শিউলি, কাঞ্চন, চাঁপা। বর্ষাকালে পায়ে পায়ে গন্ধ পাল্টায়। বাতাস ভ’রে থাকে একবুক সুন্দর গন্ধে। একটু হাঁটতে বেরিয়েছি। অন্ধকারে দেখা হল এই পাহাড়ের যুগলপ্রসাদের সঙ্গে। বহুবছর ধরে এই মহার্ঘ্য জঙ্গল তিনিই দেখভাল করছেন। তার হাতেই তৈরী অধিকাংশ গাছপালা। বড় বড় গাছের গোড়াতেও জল দেন। বলেন, গাছের আরাম হয়। আমি বললাম, ইসবার ফুল কা খুশবু নেহি মিলা। যূগলপ্রসাদ বললো, নেহি, খুশবু তো হ্যায়। হর পেঢ় সে খুশবু আ রহা হ্যায়। হবে হয়তো। আমি ফুলের গন্ধ পাবার চেষ্টা করছি। যুগলপ্রসাদ প্রতিটি গাছের গায়ে আলাদা গন্ধ পায় হয়তো। খুশবু। মানুষের গায়ের মত। কত সময়! অফুরন্ত সময়। ঘড়ির কাঁটা যেন খুব স্লো। কত মাল্টি টাসকিং করতে হয় আমাদের! ফোনে কথা বলা, সাথে সাথে ওটিপি দেওয়া, তার সাথেই কারো সাথে কাজ মেটানো। যেন কেউ আগুন দিয়ে রেখেছে পেছনে। ফোন যেতে না যেতে রীল চলে আসছে। একের পর এক।

এখানে আজ রীলের জগৎ ছেড়ে রেখে এসেছি। আজ বাসন্তী নেহী নাচেগি। খানিক বই পড়লাম। অমৃত কুম্ভের সন্ধানে। খানিক পুরনো ফোটো দেখলাম। কিছু লেখালেখির চেষ্টা করলাম। সবেতেই শান্তি। ফোন ডাকছে না। টানছেও না। একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। সামনের কাছের পাহাড়টার পেটে দেখছি আলো জ্বলছে। কেউ ঘর বেঁধেছে বোধহয় জঙ্গলের মধ্যে। কোথাও কোনও মানুষ নেই। চিতাবাঘ ঘুরে বেড়ায় এই পাহাড় জঙ্গলের আনাচে কানাচে। বাড়ির কথা মনে হচ্ছে কেবল। দিদিমার বয়স হয়েছে। শরীরটাও ভাল নেই। মেয়েটা অত দূরে একা একা রয়েছে। সব ঠিকই আছে নিশ্চয়। শকুন্তলাকে রিজর্টের নাম্বার দেওয়া আছে। প্রয়োজনে কন্টাক্ট করতে পারবে। শীত লাগছে খোলা বারান্দায়। শীতের কোনও পোষাকও আনা হয়নি। মার্চের শেষেও রাজস্হানে এরকম ঠান্ডা হবে কে ভেবেছিল? ঘরে ঢুকে বারান্দার দিকের জানলা সব খুলে দিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুলাম। ঠান্ডা লাগবে না।

আরাবল্লির ঠান্ডা শুকনো। ঘুম চলে আসে দ্রুত। আয়েসী। সকালে ঘুম থেকে উঠেই আজ আর মোবাইলটা হাতে নিলাম না। বহুবছর ধরে ঘুম ভেঙেই মোবাইল দেখি। যেন মারাত্মক কোনও খবর আসবে। যেন ফেসবুকে আমার কোনও লেখা ব্যাপক ভাইরাল হয়ে যাবে। কিছুই হয় না। শুধু মোবাইলটা হাতে নিয়ে পকেটগুলো একবার চেক করে দেখা হয়। চেক করার পরে আবার চেক করা হয়। তারপর আবার।

আজ সকালে উঠে দূরে টেবিলের উপর ফোনটার দিকে তাকিয়ে দেখি আমার দিকে করুণচোখে তাকিয়ে রয়েছে। আমি নিইনি। চা বানিয়েছি। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি। কত পাখি! উড়ছে, বসে রয়েছে। পলাশ ফুলের বুকে ঠোঁট চালিয়ে মধু নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আমার কি আনন্দ হচ্ছে! আজ ন’টার সাইরেন নেই। কোনও পেমেন্টের ঝামেলা নেই। লজিস্টিকের কোনও প্রবলেমও আজ মেটাতে হবে না। টার্গেট নেই, দৌড় নেই, ফিনিশিং নেই একরম একটা দিন এই বারান্দায় খুব ধীরে শুরু হল। ছোটবেলার মত মনে হচ্ছে। টিভি নেই, টেলিফোন নেই, মোবাইল ফোন নেই।

তবুও দিন শুরু হয়ে গেছে। মাথাবোঝাই কাঠ নিয়ে জঙ্গলে ঘরে ফিরছে আদিবাসী মেয়ে। সকাল এখনও মেঘের মত নরম। শীতল। আমার নিজেকে খুব ভাল লাগছে। দাড়ি কাটার পর বেসিনের উপরের আয়নায় নিজেকে দেখলাম। নিজেকে দেখার সময় নেই মানুষের। নিজের সাথে কথা বলার সময় নেই। বই পড়তে বসেছে তো ফোন ডাকছে, ফোন ধরেছে তো কলিং বেল বাজছে। দরজা খুলে দেখে তো কেউ নেই। বারে বারে দরজা খোলে, কিন্তু কেউ আসে না। কেউ কোথাও আসে না। কেউ কোথাও যায়ও না। মানুষ শুধু মোবাইলে থাকে। নিজের সঙ্গে থাকতে কেমন লাগে, ভুলে গিয়েছে সে। বাথরুমের যে দেওয়ালটা পাহাড়ের দিকের, সেই দেওয়ালটা জুড়ে একটা পাহাড়মুখী জানলা। আমি জানলা থেকে সব পর্দা সরিয়ে দিলাম। সামনের পাহাড়ের গায়ে ফুটে রয়েছে থোক থোক পলাশ গাছ। বাইরেটা যেন ভেঙেচুরে এসে পড়ছে বাথরুমের ভিতর।

কী আলো! আমি গীজার অন করে দিলাম। ছাদের পরের সোলার প্যানেলে জল গরম হয়। মাথার উপরের শাওয়ার থেকে আরাবল্লির খনিজ মেশানো ধোঁয়াওড়া জল পড়ছে। বাইরে কাঁচের মত সুন্দর পৃথিবী। খোলা। আমি জলের নিচে নগ্ন হয়ে দাঁড়াই। বাইরে এক পৃথিবী নির্জনতা। ছবি – জয়দীপ রায় ।

Previous articleRaktakarabiচৈতির হাত ধরে নতুন আঙ্গিকে রক্তকরবী’তে ফের অধ্যাপকের ভূমিকায় আসছি : অশোক মজুমদার
Next articleMotua রাজনৈতিক বিবাদ ভুলে  ঠাকুরনগরে শুরু মতুয়াদের বারুণী মেলা, বিশেষ লোকাল ও এক্সপ্রেস ট্রেন ঘোষণা রেলের

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here