কলকাতা: “দু’মাস আগে বিপ্লব করেছেন। আর তারপর অ্যাডভান্স নিয়ে তৃণমূলের মঞ্চে নাচ-গান করবেন ওসব এবার হবে না।” কয়েকদিন আগে আরজি কর আন্দোলনে যোগ দেওয়া শিল্পীদের এই ভাষাতেই বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ। তা নিয়ে চাপানউতোর চলছিলই।
এবার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদী শিল্পীদের বয়কট করার কোনও নির্দেশ তৃণমূল দেয়নি বলে সাফ জানালেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বিষয়ে দলে কোনও আলোচনা হয়নি বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ গত ৩০ ডিসেম্বর সোশ্যাল মিডিয়ায় এ বিষয়ে যে পোস্ট করেছিলেন তা একান্তই ব্যক্তিগত বলেও জানিয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
কোনও অনুষ্ঠানে কোন শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হবে, তা একান্তই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে বলে মনে করেন তিনি। যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে এমন বয়কটের সংস্কৃতি রয়েছে, রাজ্যে বাম জমানায় নন্দীগ্রাম–সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ে এই বয়কটের আবহ তৈরি হয়েছিল বলে ডায়মন্ড হারবারের সাংসদের পর্যবেক্ষণ। কিন্তু তৃণমূল এমন সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী নয় বলেও এদিন স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন তিনি।
আরজি করের ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদী শিল্পীদের একাংশকে বয়কট করার ডাক দিয়ে কুণাল নিজের পোস্টে লিখেছিলেন, ‘কোনও তৃণমূল নেতার কোনও বিভ্রান্তি থাকলে উচ্চতর নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে নিন।’ কুণালের এই পোস্টকে তৃণমূলের অবস্থান বলে অনেক শিল্পী মনে করেছিলেন। এমনকী, তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যুব নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য কুণালের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিলেন। ফলে প্রতিবাদী অনেক শিল্পী আশঙ্কা করেছিলেন, তাঁরা বয়কটের মুখে পড়তে পারেন।
যদিও ডায়মন্ড হারবারে ‘সেবাশ্রয়’ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরে অভিষেক বলেন, ‘পার্টির তরফ থেকে কেউ নির্দেশ দিয়েছে? কোনও নোটিফিকেশন দেখেছেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কর্মসমিতির মিটিং ডেকেছিলেন তখন এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে আপনারা শুনেছেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু বলেছেন? নাকি দলের তরফে আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কিছু বলেছি? রাজ্য সভাপতি কিছু বলেছেন?––– না। আমরা সবার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।’
অভিষেক দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করে দিলেও কুণাল মনে করছেন, তিনি কোনও ভুল কথা বলেননি। কুণালের বক্তব্য, ‘প্রতিবাদী মানেই বয়কট, তা একবারও বলা হয়নি। যাঁরা প্রতিবাদের নামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করেছেন, সে রকম কয়েকজনকে (বয়কটের কথা) বলা হয়েছে। তৃণমূলের একজন কর্মী হিসেবে আবেগ থেকে বলেছি। একদম ঠিক বলেছি, কোনও ভুল বলিনি। আমি এ বিষয়ে আর কোনও কথা বলব না, যা বলার দলের চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলবেন। তিনি যা বলবেন তা মেনে নেব।’
অভিযোগ, প্রতিবাদী শিল্পীদের বয়কট করার ডাক দেওয়ার পরে গায়িকা লগ্নিজিতা চক্রবর্তীর একটি অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। অভিষেক তৃণমূলের অবস্থান স্পষ্ট করে দিলেও লগ্নজিতা এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। এই বয়কট নিয়ে শিল্পীদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তা অভিষেকের এদিনের কথায় স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে একজন শিল্পীর ফোন এসেছিল, তিনি বললেন, শুনছি আরজি করের সময়ে প্রতিবাদ করেছিলাম বলে আমার একটা শো হঠাৎ ক্যানসেল করে দিচ্ছে। আমি মেলা কমিটিতে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ওরা বলেন, যাঁর প্রোগ্রাম করার কথা ছিল তিনি–ই করছেন। এটাই তো বাংলার সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের পার্থক্য।’
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনায় ১৪ অগস্ট রাত–দখলের কর্মসূচিকে সমর্থন করেছিলেন অভিষেক। এই অবস্থানে তিনি যে এখনও অনড় রয়েছেন তা ফের বুঝিয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
অভিষেকের সোজাসাপটা কথা, ‘কে কোথায় রাস্তায় নেমে কী ভাবে প্রতিবাদ করবে সেটা যেমন তাঁর স্বাধীনতা, তেমনই কোন অনুষ্ঠানে কে যাবে, সেটা সেই (আয়োজক) কমিটির এক্তিয়ার। আমি জোর জবরদস্তি কারও মাথায় কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। আমার পাড়ায় একটি অনুষ্ঠান হবে, সেখানে কে মঞ্চ বাঁধবে, কে লাইট লাগাবে, কে গান গাইবে, কী প্রাইজ আসবে, কী খাবারের প্যাকেট আসবে, তাতে লুচি, নাকি ডাল–ভাত থাকবে, যাঁরা আয়োজন করছে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন।’
যা দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বড় অংশের মত, আদপে অভিষেকের বক্তব্যকে গুরুত্বহীন করে দিলেন কুণাল। সে কারণেই বারবার করে বললেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললে মেনে নেব। এখন দেখার শেষ পর্যন্ত জল কোনদিকে গড়ায়।