২৪ ঘণ্টা পরেও জলযন্ত্রণা থেকে সম্পূর্ণ নিস্তার পেল না কলকাতা! উত্তর থেকে দক্ষিণের বহু এলাকা এখনও জলমগ্ন


আজ তৃতীয়া। সকাল থেকে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় রোদ উঠেছে। আকাশ ঝকঝকে না হলেও ভারী বৃষ্টি তেমন হয়নি। মঙ্গলবার দিনভর দুর্যোগের পর বুধবার সকালে রোদ দেখে খুশি সকলেই। তবে, আশঙ্কার বিষয় আগামিকাল ফের ভারী বৃষ্টির ভ্র্কুটি রয়েছে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে। আলিপুর আবহাওয়া অফিস জানাচ্ছে, নতুন করে নিম্নচাপ তৈরি হবে, শনিবার থেকে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে সঙ্গে বজ্র-বিদ্যুৎ ও ঝোড়ো হাওয়াও বইতে পারে। ফলে সব মিলিয়ে দুর্যোগের মেঘ এখনই কাটছে না।

এদিকে মঙ্গলবার সকালে কলেজ স্ট্রিটে প্রায় হাঁটুসমান জল জমে গিয়েছিল। বুধবার সকালে কলেজ স্ট্রিটে ‘বর্ণপরিচয়’ বাজারের কাছে রাস্তার একটি অংশে এখনও কিছুটা জল জমে আছে। এ ছাড়া ঠনঠনিয়া, রাজা রামমোহন সরণি, কেশব সেন স্ট্রিট, আনন্দ পালিত রোড, বালিগঞ্জ ফাঁড়ি, ভিআইপি বাজার, নিউ গড়িয়া আবাসন, টেগোর পার্ক-সহ বিভিন্ন জায়গায় এখনও রাস্তায় জল জমে আছে।

বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে এখনও হাঁটুর কাছাকাছি জল জমে আছে। এ ছাড়া পাটুলির একাংশ, গড়িয়া, নিউ গড়িয়া, সন্তোষপুর এভিনিউ, পার্ক সার্কাসের একাংশ, তপসিয়ার ভিতরের গলিপথ, বোসপুকুর তালবাগান এলাকা, আমহার্স্ট স্ট্রিট, নাগেরবাজারের একাংশ, বউবাজার, মহাত্মা গান্ধী রোড, মেটিয়াবুরুজের একাংশ, বরিশার একাংশ, সরসুনা এবং জোকায় এখনও জল জমে আছে। কাঁকুরগাছি আন্ডাসপাসে এখনও জল জমে আছে। এজেসি বোস রোড সংলগ্ন মিন্টো পার্ক, ক্যামাক স্ট্রিটেও জল পুরোপুরি নামেনি। গড়িয়াহাট রোড আইটিআইয়ের কাছে বুধবার সকালেও জল জমে আছে। মঙ্গলবার যা পরিস্থিতি ছিল, তার তুলনায় খুব বেশি উন্নতি হয়নি এখানে। তবে পুরসভার তরফে বিভিন্ন জায়গায় পাম্প চালানোর ফলে অনেক জায়গাতেই জল আগের তুলনায় কমেছে।

মঙ্গলবার অনেকেই বাড়ি থেকে বেরতে পারেননি, ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা খুব প্রয়োজন ছাড়া অফিসে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু বুধবার সকালে আবহাওয়ার উন্নতি হওয়ায় অনেকেই অফিস যাচ্ছেন। আবহাওয়ার উন্নতি হলেও কলকাতার চিত্রটা গতকালের চেয়ে আজ তেমন পাল্টায়নি। এখনও কোথাও হাঁটু জল বা কোথাও কোমর পর্যন্ত জলও রয়েছে। ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও নামেনি এতটুকু।

কলকাতার আনন্দ পালিত রোডে জল রয়েছে অনেকটাই। একই অবস্থা সিআইটি রোডের একটা বড় অংশেও। জল এড়িয়ে রাস্তার এক পাশ দিয়ে চলছে গাড়ি ও বাস। এখন তেমন সমস্যা নাহলেও অফিস টাইম শুরু হলে যানজটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, জল দিয়েই হাঁটতে হচ্ছে। কাল যা ছিল! আজ অনেকটা কমেছে। সকলের ভরসা এখন রিকশা।

সময় যত গড়াবে জল নামবে বলে মনে করছেন পুর আধিকারিকরা কিন্তু কতক্ষণে নামবে তা স্পষ্ট নয়। এদিকে লকগেট বন্ধ হবে বেলা ১২টা থেকে ১২.৩০টা নাগাদ, ফলে বৃষ্টি না হলেও জল তখন আর নামবে না।
আলিপুর জানাচ্ছে, আগামিকাল থেকে একাধিক জেলায় ভারী বৃষ্টি হবে। শনিবার থেকে বজ্র বিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি। তালিকায় রয়েছে কলকাতাও। চিন্তায় পুজো উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা।
মঙ্গলবার ভিআইপি বাজার, টেগোর পার্ক-সহ বাইপাসের প্রায় সব কলোনিতেই প্রচুর জল জমেছিল। বেশিরভাগ এলাকায় জল নেমে গেলেও, অনেক জায়াগায় রয়েছে এখনও। বেশ কিছু দোকান বন্ধ বুধবার সকালেও, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে রাস্তার। টেগোর পার্কে এখনও হাঁটু সমান জল। গাড়ির বনেট পর্যন্ত জল উঠে যাচ্ছে ফলে গাড়িতে যাতায়াত করা সম্ভব হচ্ছে না। নিত্য যাত্রীরা বলছেন, ‘ক্যাব পাওয়া যাচ্ছে, গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না, এই পরিস্থিতিতে কেউ অসুস্থ হলে কী হবে। পাম্প চালিয়ে জল বের করা হয়নি। আবার নিম্নচাপ বলছে। কোথায় যাব?’
ওই এলাকারই এক ব্যবসায়ী জানালেন, দোকান গতকাল বন্ধ ছিল। খোলার চেষ্টাও করেননি। পরে রাতে দেখেন, খাবার-দাবার, আইসক্রিম, কেক সব নষ্ট হয়েছে। পুজো এসে গেছে তাই প্রচুর সামগ্রী স্টক করেছিলেন, বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এই জল কবে নামবে, কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, কেউ জানে না।
নিউ গড়িয়া বা পাটুলির চিত্রও ব্যতিক্রম নয়। গতকাল সবচেয়ে বৃষ্টি হয়েছে এখানেই। জলবন্দি অবস্থার পরিবর্তন তেমন হয়নি। এত োজল জমে যে নিউ গড়িয়া আবাসনের একটি গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত ফ্ল্য়াটের প্রায় নীচের তলায় জল, কেউ পাম্প চালাতে পারছেন না। পানীয় জলের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এখানকার দীর্ঘদিনের বাসিন্দার অম্বিকেশ মহাপাত্র বলছেন, ‘আমার জীবদ্দশায় দেখিনি এমন। ভারী বর্ষণের ফলে এই এলাকাও প্লাবিত, ভেবেছিলাম নেমে যাবে ২৪ ঘণ্টায় কিন্তু কোথায় কী, জল নামেইনি। পানীয় জলের সমস্যা হচ্ছে। একটা দিন কোনওভাবে চালিয়ে নেওয়া গেছে। আজ কী হবে, সেটা নিয়ে চিন্তায় সকলে। জল কিনে খেতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি কীভাবে তা বোঝা যাচ্ছে না।’

জল নামেনি সে অর্থে পাটুলির বেশ কিছু এলাকাতেও, ফলে ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কীভাবে অফিস যাবেন, কীভাবে খাবার জোগার করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না অধিকাংশই।
মঙ্গলবার লোকাল ট্রেন এবং মেট্রো পরিষেবায় যে বিপত্তি ঘটেছিল, সেই ছবিও আপাত ভাবে বদলে গিয়েছে বুধবার। শিয়ালদহ (মেন এবং উত্তর) এবং হাওড়া উভয় শাখাতেই সকাল থেকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে চক্ররেল পথের কলকাতা স্টেশনে এখনও জল জমে রয়েছে। সেই কারণে কিছু ট্রেনের যাত্রাপথ পরিবর্তন করা হয়েছে। মেট্রো পরিষেবাও স্বাভাবিক সকাল থেকে।
পুজোর মরসুমে কলকাতাকে দ্রুত জলযন্ত্রণা থেকে নিস্তার দেওয়া ‘চ্যালেঞ্জ’ হয়ে উঠেছে পুরসভার কাছে। সোমবার রাতভর নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েছে কলকাতায়। বৃষ্টি থামার পরেও দীর্ঘক্ষণ জল নামেনি শহর থেকে। গঙ্গায় জোয়ারের কারণে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা আরও কঠিন হয়ে ওঠে প্রশাসনের কাছে। এই পরিস্থিতিতে শহরের জলযন্ত্রণার কথা মেনে নিলেও, ফিরহাদ জানিয়েছিলেন তিনি অপারগ। পরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠকে মেয়র জানান, সকালের বানভাসি পরিস্থিতির খানিকটা হলেও উন্নতি হয়েছে। পুরসভার কন্ট্রোল রুম থেকে সর্বক্ষণ নজরদারি চলছে। রাতের মধ্যেই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হবে। মেয়র এ-ও জানিয়েছিলেন, পাম্প বসিয়ে পুরসভা জল নামানোর চেষ্টা করেছে।
প্রথম নিম্নচাপের প্রভাব কেটে যাওয়ায় আজ বুধবার দক্ষিণবঙ্গের কোথাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। কয়েক জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে। দিনের বেলায় তাপমাত্রা অনেকটাই বেশি থাকবে। পাশাপাশি বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় বাড়বে আর্দ্রতাজনিত অস্বস্তিও।
তবে নয়া নিম্নচাপের প্রভাবে বৃহস্পতিবার থেকে ফের বৃষ্টি শুরুর সম্ভাবনা থাকছে। হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হবে উপকূলের প্রায় সব জেলাতেই। ওডিশা সংলগ্ন জেলাগুলিতে ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা থাকছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টির আশঙ্কা থাকছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সারাদিনই বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির সম্ভাবনা কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের সব জেলাতেই।
শনিবার থেকে বাড়বে বৃষ্টি। বাঁকুড়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, হাওড়া এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকছে। শনিবার কলকাতাতেও বাড়বে বৃষ্টি। পুজোর মধ্যে রবিবার, সোমবার ও মঙ্গলবার অর্থাৎ ষষ্ঠী, সপ্তমী এবং অষ্টমীতে বিক্ষিপ্তভাবে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দক্ষিণবঙ্গে। তবে নবমী ও দশমীতে বৃষ্টি অনেকটাই বাড়বে বলে খবর আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে।
উত্তরবঙ্গে কোথাও তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। উত্তরের সব জেলাতেই আজ বিক্ষিপ্তভাবে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে।