

ফের বাংলায় নরেন্দ্র মোদী । শুক্রবার কলকাতায় এসে একসঙ্গে উদ্বোধন করলেন তিনটি মেট্রো রুটের- নোয়াপাড়া–জয় হিন্দ বিমানবন্দর, শিয়ালদহ–এসপ্ল্যানেড এবং বেলেঘাটা–(রুবির মোড়) হেমন্ত মুখোপাধ্যায় । এর পরে তিনি দমদম সেন্ট্রাল জেলের মাঠে আয়োজিত জনসভার মঞ্চে পৌঁছন। সেখানে কী বললেন তিনি?

বাদল অধিবেশন শেষ হওয়ার ঠিক আগে নতুন বিল পেশ করে আলোড়ন তৈরি করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বিল পাঠানো হয়েছে যৌথ সংসদীয় কমিটিতে। শুক্রবার কলকাতায় এসে সেই বিল নিয়েই বার্তা দিলেন
তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে বাংলার মন্ত্রীরাও গ্রেফতার হয়েছেন, জেল খেটেছেন।
শুক্রবার দমদমের সভা থেকে প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন রাজ্যের দুই প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথা। ১৩০ তম সংবিধান সংশোধনী বিলের গুরুত্বও এদিন বোঝান তিনি।

শুক্রবারের সভা থেকে মোদী বলেন, “এবার লোকসভায় বিজেপি এক বড় দুর্নীতি-বিরোধী বিল নিয়ে এসেছে। বাংলাকেও সেই বিলের কথা বলব।
আমাদের দেশে একজন সরকারি কর্মী, সে সাফাইকর্মী হোক বা গাড়ি চালক, তাঁকে জেলে ঢোকানো হলে ৫০ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি না পেলে, নিয়ম অনুযায়ী সাসপেন্ড হয়ে যায়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বা মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী যদি জেলে চলে যায়, তাহলে তাদের জন্য কোনও আইন নেই।”

এরপরই নাম না করে দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালকে নিশানা করেন মোদী। তিনি বলেন, “মানুষ এত নীচে নেমে গিয়েছে যে জেল থেকেও সরকার চালানোর চেষ্টা করছে। সেখান থেকেই সরকার চালাচ্ছে। এটা সংবিধানের অপমান।”
পার্থ-প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ দেখেছে, নিয়োগ দুর্নীতিতে এমন একজন জেলে গিয়েছেন, যাঁর বাড়ি থেকে নোটের পাহাড় মিলেছে, তাও তিনি চেয়ার ছাড়তে রাজি ছিলেন না। তৃণমূলের আরও এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে রেশন দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। তিনিও চেয়ার ছাড়তে রাজি ছিলেন না। এমন লোক যারা মানুষকে প্রতারণা করেছে, তাদের সরকারি পদে থাকার অধিকার কি আছে?”
প্রসঙ্গত ,শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও বনমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে গ্রেফতার করা হয়।দুর্নীতির অভিযোগে জেল হেফাজতে যেতে হয় তাঁদের। পরে জ্যোতিপ্রিয় জামিনে ছাড়া পেলেও, এখনও জেলেই আছেন পার্থ। তাঁরা পদত্যাগ করেননি। তৃণমূল পার্থকে সাসপেন্ড করেছিল।
অনুপ্রবেশ ইস্যুতে সরব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি বলেন, ‘এখান থেকে অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াতে হবে তো? কে তাড়াবে? আপনাদের ভোট। বিজেপিকে জেতান। অনুপ্রবেশকারীরা বাংলা ছেড়ে পালাবে।’ ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে যে এই ইস্যুকে সামনে রেখে ময়দানে নামবে বিজেপি, তা একপ্রকার এ দিন স্পষ্ট করে দিলেন মোদী।
বাংলায় বিধানসভা ভোটের এখনও ৮ মাস বাকি। তার আগে গত চার মাসের মধ্যে এই নিয়ে তৃতীয় বার সফরে এলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী । এবং এখন থেকেই একটা বিকল্প উন্নয়নের মডেল দেখাতে শুরু করে দিলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী যে তাঁর বক্তৃতায় সরসারি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম মুখে আনবেন না তা আগেই দেশের সময় -এ লেখা হয়েছিল। সেটাই হয়েছে। তবে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে চড়া স্বরে আক্রমণকে ছাড়েননি প্রধানমন্ত্রী। বাংলার ‘ভদ্রলোকদের’ উদ্দেশে তাঁর স্পষ্ট আহ্বান— তৃণমূলকে বিদায় দিন। ওরা থাকলে বাংলার ভাল হবে না।
প্রধানমন্ত্রী এদিন অভিযোগ করেন, দিল্লি থেকে বাংলার উন্নয়নের জন্য পাঠানো টাকা রাজ্যের সাধারণ মানুষের জন্য খরচ হয় না, সেই টাকা লুঠ হয়ে যায়। দিল্লির পাঠানো টাকা সাধারণের জীবন সুগম ও সহজ করতে খরচ হয় না, তা খরচ হয় তৃণমূলের ক্যাডারদের জন্য। তিনি বলেন, “অন্য রাজ্যে স্মার্ট সিটি মিশন, পরিকাঠামো উন্নয়ন এগোচ্ছে। কিন্তু বাংলায় তৃণমূল সরকার কেন্দ্রের প্রকল্প আটকে দিচ্ছে। প্রশ্ন হল, বাংলার ভদ্রলোকরা কি এমন রাজনীতি চান?”
মোদী স্মরণ করান, স্বাধীনতার পর কংগ্রেস ও বামেদের দীর্ঘ শাসনের পরে মানুষ ২০১১ সালে ‘মা-মাটি-মানুষ’- এর ওপর ভরসা রেখেছিল। কিন্তু তাঁর দাবি, পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে। ভর্তি দুর্নীতি থেকে মহিলাদের ওপর অত্যাচার, অপরাধ থেকে কৃষক-অবহেলা— প্রতিটি ক্ষেত্রেই তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তাঁর কথায়, “বাংলা কাজ চায়, বাংলা মেয়েদের সুরক্ষা চায়, কৃষকদের সম্মান চায়। অপরাধীদের জায়গা সরকার নয়, জেলে। এই পরিবর্তন আনতে পারে কেবল বিজেপি।” বিজেপি সরকার এলে বাংলায় শিল্পের নবজাগরণ হবে বলে আশ্বাস দেন মোদী। দমদম-সহ একাধিক শিল্পাঞ্চলকে ফের কারখানার শহর বানানো, মেট্রো ও রেলের নেটওয়ার্ক বাড়ানো, গঙ্গায় ক্রুজ ট্যুরিজম ও হেরিটেজ ট্যুরিজমের বিকাশ ঘটানো, এবং তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। তাঁর দাবি, “বিকশিত বাংলা মোদীর গ্যারান্টি।”
অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য তুলে ধরে মোদী কংগ্রেসকে আক্রমণ করেন। তাঁর অভিযোগ, কংগ্রেস সেনাকে বিদেশনির্ভর করেছিল, অথচ বিজেপি সরকার দেশীয় অস্ত্র দিয়েই পাকিস্তানকে শিক্ষা দিয়েছে। ইছাপুরে আধুনিক রাইফেল তৈরির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা শিল্প নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে, স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে।
মোদীর ভাষণের বড় অংশ জুড়ে ছিল অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, “অনুপ্রবেশকারীরা বাংলার চাকরি কেড়ে নিচ্ছে, কৃষকদের জমি দখল করছে, মা-বোনেদের উত্যক্ত করছে। বাংলার ডেমোগ্রাফি পাল্টে যাচ্ছে। বিজেপিই এই অনুপ্রবেশ রুখতে পারবে।” তাঁর অভিযোগ, তৃণমূল-কংগ্রেস ও ইন্ডি জোটের কয়েকটি দল তুষ্টিকরণের রাজনীতিতে ডুবে রয়েছে।
মোদী এদিন সংসদে আনা অ্যান্টি কোরাপশন বিলের প্রসঙ্গও তোলেন। তাঁর বক্তব্য, ছোট কর্মচারী ৫০ ঘণ্টা জেলে থাকলেই চাকরি যায়, অথচ মন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীরা জেলে থেকেও পদ আঁকড়ে থাকেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি তৃণমূলের একাধিক মন্ত্রীর দুর্নীতির মামলা ও জেল যাত্রার প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তাঁর কটাক্ষ— “তৃণমূল আইন মানে না, সংবিধান মানে না।”
কলকাতা শহরে এই সভা নিঃসন্দেহে বিজেপির নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ। মোদী একদিকে আবেগের আবহ— কুমোরটুলির প্রতিমা, বড়বাজার- পার্কস্ট্রিটের কেনাকাটার ব্যস্ততা— তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে উন্নয়ন ও দুর্নীতিবিরোধী বার্তায় ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন।
তাঁর বারবার উচ্চারিত স্লোগান— “বাঁচতে চাই, বিজেপি তাই”— নির্বাচনী প্রচারের মূল মন্ত্র হিসেবেই সামনে আসছে। তৃণমূল সরকারকে সরিয়ে বিজেপিকে সুযোগ দেওয়ার আহ্বান, অনুপ্রবেশ ইস্যুতে সরাসরি অবস্থান এবং শিল্প পুনর্জাগরণের প্রতিশ্রুতি— সব মিলিয়ে দমদমের সভা থেকে মোদীর বার্তা স্পষ্ট: ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে এখনই ঝাঁপাচ্ছে বিজেপি।