দেশের সময়,ওয়েবডেস্ক:বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে বর্ণপরিচয় মোছা যাবে না। বাংলার সংস্কৃতিকে ভোলানোর চক্রান্ত করা হচ্ছে।’ মঙ্গলবার হেয়ার স্কুলে বিদ্যাসাগরের মূ্র্তি উন্মোচন করে এমনটাই বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মূর্তিটি এরপর গাড়িতে করে বিদ্যাসাগর কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। মূর্তির সঙ্গে কলেজ পর্যন্ত হেঁটে যান মমতা।
যেখানে মূর্তি ভাঙা হয়েছিল, সেখানেই বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি নিজে হাতে প্রতিস্থাপন করেন মুখ্যমন্ত্রী। তারপর মূর্তিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান রাজনৈতিক থেকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টরা। কলেজের বাইরে চত্বরে বিদ্যাসাগরের পূর্ণাবয়ব মূর্তিরও উন্মোচন করেন মমতা। প্রসঙ্গত, শেষ দফা ভোটের আগে কলকাতায় অমিত শাহ্–এর প্রচার মিছিলের সময় তাণ্ডবে ভেঙে গিয়েছিল বিদ্যাসাগরের মূর্তিটি।
নাম না করে এদিন মমতা অমিত শাহ্–কে কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘আজ যিনি কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাঁর মিছিলে গুন্ডামি হয়েছিল। এই মূর্তি কোনও বাচ্চা ভাঙেনি। বুড়ো খোকারা মূর্তি ভাঙলে ভাবতেই হয়। যারা আম্বেদকর, পেরিয়ারের মূর্তি ভেঙেছে তারা তো রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙবেই। আমরাও তো ৩৪ বছর পর ক্ষমতায় এসেছি, আমাকে তো লেনিনের মূর্তি ভাঙতে হয়নি।’ বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় বাংলার মননে আঘাত লেগেছে বলে মন্তব্য করে মমতার হুঁশিয়ারি, ‘মনে রাখবেন বাংলা ফেলনা নয়, বাংলা খেলনা নয়। বাংলাকে যারা অবজ্ঞা করে তাদের জন্য আমি ভয়ঙ্কর।
রামকৃষ্ণ মিশন বা ভারত সেবাশ্রমের সন্ন্যাসীরাও গেরুয়া পরেন। সবার দ্বারা গেরুয়া হয় না।’ বিদ্যাসাগর কলেজ ভালোভাবে সাজিয়ে তুলতে রাজ্য সরকার এক কোটি টাকা দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রীর কথায় উঠে এসেছে সন্দেশখালি, গলসি, ভাটপাড়ার অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিও।
তাঁর মন্তব্য, ‘স্পিচ ইজ সিলভার, সায়লেন্স ইজ গোল্ডেন। সন্দেশখালির ঘটনার পিছনে বিজেপির হাত আছে বলে অভিযোগ করে তাঁর প্রশ্ন, ‘কেন এত খুন। ওরা কী বাংলাকে গুজরাট বানাতে চায়। আমি গুজরাটিদের ভালোবাসি, দাঙ্গাবাজদের নয়। আমি কোনও মৃত্যুই মানতে পারব না। কিন্তু সন্দেশখালিতে যারা মারা গিয়েছে তাঁরা তৃণমূলকর্মী কায়ুমকে মারতে গিয়েছিল।’ রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে মমতার অভিযোগ, তিনি অনৈতিক কথা বলছেন। কারণ সন্দেশখালিতে ১০ জন মারা গিয়েছেন অথচ রাজ্যপাল ১২ জন মারা গিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রকে।
গোটা ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছিল মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে। লোকসভা নির্বাচনের শেষ দফার ভোট গ্রহণের আগে কলকাতায় রোড শো করেছিলেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। তাঁর রোড শো চলাকালীন ধুন্ধুমার হয়েছিল বিদ্যাসাগর কলেজে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি মূর্তিও ভাঙা হয়েছিল ওই সংঘর্ষে। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ওই ঘটনাকে বাংলার সংস্কৃতি ও চিন্তার উপর আঘাত বলে তার পর থেকেই জোরদার প্রচারে নেমে পড়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে তিনি এও বলতে শুরু করেছিলেন, বাংলার বাইরে থেকে রোড শো-র জন্য লোক এনেছিল বিজেপি। তারাই ভেঙেছে বিদ্যাসাগরের মূর্তি।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, ওই ঘটনার পর শেষ দফায় যে ৯টি আসনে ভোট গ্রহণ হয়েছিল, তার সব কটিতেই জিতেছে তৃণমূল। তাতে শাসক দলের শীর্ষ স্তরে এই ধারনা এখন বদ্ধমূল হয়েছে যে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙারই খেসারত দিতে হয়েছে গেরুয়া শিবিরকে। ফলে এখন বাংলা ও বাঙালি লাইন আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে চাইছে রাজ্যের শাসক দল।
তৃণমূলের সেই রাজনৈতিক কৌশল এ দিন পুরোদস্তুর ধরা পড়ে হেয়ার স্কুলে অনুষ্ঠানের ছবিতে। সরকারি অনুষ্ঠান হলেও মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা ছিল এ দিন ষোলো আনা রাজনৈতিক। কখনও তিনি বাংলার রাজনৈতিক হিংসার ঘটনার কথা বলেন। কখনও রাজ্যপালের সমালোচনা করেন। কখনও আবার গেরুয়া শিবিরকে হুঁশিয়ার করে বলেন,“বাংলা ছেলের হাতের মোয়া নয়। এখানে যা ইচ্ছে তাই করা যায় না। বাংলাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে।”
এখানেই থামেননি মুখ্যমন্ত্রী। সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতির প্রসঙ্গও উঠে আসে তাঁর বক্তৃতায়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমরা বাঙালি নই? আমরা হিন্দু নই? কিছু বললেই বলছে মুসলমান তোষণ করি। এই যে মঞ্চে আবুল বাশার বসে আছেন। তাঁকে বলব আপনি চলে যান? আমি থাকি আর না থাকি (পড়ুন সরকারে) ওই কাজ আমাকে দিয়ে করাতে পারবে না।”
প্রাদেশিকতা বাদের রাজনীতি এ দেশে নতুন নয়। এক সময়ে বালা সাহেব ঠাকরে সেই রাজনীতি করে সফল হয়েছিলেন। দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিতেও প্রাদেশিকতাবাদ ভরপুর বাস্তব। বিশেষ করে তামিলনাড়ুতে। এখন প্রশ্ন হল, বাংলাতেও কি সেই রাজনীতি ফল দেবে?
অনেকের মতে, এ ব্যাপারে এখনই শেষ কথা বলার সময় আসেনি। তার প্রমাণ পাওয়া যাবে দু’বছর বাদে ভোটে। তবে মমতার এই কৌশল আন্দাজ করে বিজেপি-ও পাল্টা আক্রমণে নেমে পড়েছে এ দিন। ভোটে প্রচারে এসে নরেন্দ্র মোদীই ঘোষণা করেছিলেন যে বাংলায় বিদ্যাসাগরের একটি ভব্য মন্দির গড়ে দেবে কেন্দ্রের সরকার।
এ দিন, বিজেপি মুখপাত্র সায়ন্তন বসু বলেন, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক রয়েছে? কেউ এমন দাবি করতে পারবে? যে মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তুই তোকারি বলে সম্বোধন করেন, তাঁর মুখে বাংলার সংস্কৃতির কথা মানায়? বিদ্যাসাগর কলেজে যে দলের ছাত্র সংগঠন ভর্তির সিন্ডিকেট চালিয়েছে, যে দলের ছাত্র নেতারা কলেজে কলেজে অধ্যক্ষকে মারধর করে, কলেজের শিক্ষিকা জগ ছুঁড়ে মারে, তাদের মানুষ চিনে গেছে। দিদিমণির এই রাজনীতিতে চিড়ে ভিজবে না।