কলকাতায় শুরু হয়েছে ফরাসি চলচ্চিত্র উৎসব। উপস্থিত ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা, অভিনেত্রী এবং প্রখ্যাত চিত্র পরিচালকেরা।

হীয়া রায় , দেশের সময় : নাম শুনেছেন, কিন্তু দেখা হয়নি। ফ্রান্স এবং ভারতের এমন বহু ছবির সম্ভার নিয়ে কলকাতার বুকে শুরু হয়েছে ফরাসি চলচ্চিত্র উৎসব। শহরে দ্বিতীয় বারও ফরাসি ছবির উৎসব সফল হবে, এমনটাই আশা রাখেন উদ্যোক্তা আলিয়াঁস ফ্রঁসের কর্ণধার এবং ভারতীয় পরিচালকেরা।
গত শনিবার সন্ধ্যায় নন্দনের ১ নম্বর প্রেক্ষাগৃহে ফরাসি চলচ্চিত্র উৎসবের সূচনা হয় ভারত এবং ফ্রান্স দুই দেশের সিনে-প্রেমী মানুষজনের উদ্যোগে। উৎসবের প্রধান অতিথি ছিলেন মুম্বইয়ের খ্যাতনামা অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ। উপস্থিত ছিলেন ফ্রান্সের কনসাল জেনারেল, কলকাতা দিদিয়ের তালপেঁ, অ্যালিয়াঁস ফ্রঁসে দ্যু বেঙ্গালে-র ডিরেক্টর নিকোলাস ফ্যাসিনো, ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ, অনুভব সিংহ, তৃষাণ সরকার, অভিনেত্রী অনসূয়া সেনগুপ্ত, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, রুক্মিণী মৈত্র, ফরাসি চলচ্চিত্র উৎসবের উপদেষ্টা প্রীতিময় চক্রবর্তী প্রমুখ।

শুধু দিন নয়, সারা রাত সিনেমা দেখার সুযোগ থাকবে চলচ্চিত্র উৎসবে। ১ মার্চ পর্যন্ত ভারতীয় এবং ফরাসি মিলিয়ে ৫০টির বেশি ছবি দেখার সুযোগ পাবেন দর্শকেরা। ২৮ ফেব্রুয়ারি এবং পয়লা মার্চ স্বল্প দৈর্ঘ্যের ফরাসি ছবি দেখার সুযোগ থাকছে রাত ন’টা থেকে সকাল সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত। পয়লা মার্চ পর্যন্ত নন্দনের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে দুপুর দেড়টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তিন দফায় ফরাসি এবং ভারতীয় ছবি দেখানো হবে।
উৎসবের তালিকায় ফ্রান্সের সমসাময়িক ছবি থেকে শুরু করে অতীতের বিখ্যাত ছবি, অ্যানিমেশন যেমন জায়গা পাচ্ছে, তেমনই চলচ্চিত্রপ্রেমীরা কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত কয়েকটি জনপ্রিয় ছবি দেখারও সুযোগ পাবেন।
গত বছর ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে ‘আন সার্টেন রিগার্ড’ বিভাগে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন কলকাতার মেয়ে অনসূয়া সেনগুপ্ত। যে ছবির জন্য পুরস্কার প্রাপ্তি, সেই ‘দ্য শেমলেস’ ছবিটিও এ বার কলকাতাবাসী দেখার সুযোগ পাবেন ২৩ ফেব্রুয়ারি রবিবার দুপুর তিনটের সময় নন্দন ২ প্রেক্ষাগৃহে।
‘ইন্ডিয়া অ্যাট কানস’ বিভাগে দেখানো হবে মৃণাল সেনের ‘খারিজ’, নন্দিতা দাসের ‘মান্টো’ এবং সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’। এই তালিকাতেই থাকবে ‘দ্য শেমলেস’ ছবিটিও। শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ‘মন্থন’, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনীত ‘অলীক সুখ’ থাকছে চলচ্চিত্র উৎসবে। ‘সুগার অ্যান্ট স্টার’, ‘আই, দ্য সং’, ‘পেটি ভ্যাম্পায়ার’, ‘দ্য ব্ল্যাক টিউলিপ’-সহ বেশ কিছু ফরাসি ছবি দেখার সুযোগ মিলবে এবার।

নন্দনে অনুষ্ঠিত কলকাতার ফরাসি চলচ্চিত্র উৎসবে গৌতম ঘোষের হিন্দি ছবি ‘রাগীর’ সমালোচকদের বহু প্রশংসা কুড়িয়েছে । এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, প্রখ্যাত বলিউড অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ; পরিচালক ও অভিনেতা গৌতম ঘোষ; প্রযোজক অমিত আগরওয়াল; অ্যালায়েন্স ফ্রাঁসেস ডু বেঙ্গলের পরিচালক নিকোলাস ফ্যাসিনো , কলকাতায় ফ্রান্সের কনসাল জেনারেল দিদিয়ের তালপেইন এবং আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। রাগীর প্রযোজনা করছেন অমিত আগরওয়াল। তাঁর প্রযোজনা সংস্থা আদর্শ টেলিমিডিয়া আন্তর্জাতিক ও জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবের মাধ্যমে সফল যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। ছবিতে আদিল হুসেন, তিলোত্তমা শোম এবং নীরজ কবির অসাধারণ অভিনয়ের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসা অর্জন করেছে ইতি মধ্যে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষের কথায়, “আমি যখনই কিছু তৈরি করি, তখন তা অন্তরের তাগিদ এবং স্পষ্ট উদ্দেশ্য থেকে আসে। রাগীর মানবতা এবং করুণার কথা বলে, এবং আমি সকলকে এই সিনেমাটিক যাত্রায় আমাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।”

কিংবদন্তি অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহের উপস্থিতিতে প্রদর্শনীটি আরও বিশেষ হয়ে ওঠে, যিনি ছবিটি সম্পর্কে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ভাগ করে নেন। তিনি ‘রাগীর’ এবং ঘোষের পূর্ববর্তী কাজ ‘পার’ এর মধ্যে তুলনা করে ছবিটির আবেগজনিত গভীরতা এবং প্রাসঙ্গিকতা আরও বাড়িয়ে তোলেন।
ছবিটির প্রযোজক অমিত আগরওয়াল রাগীরের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, “ছবিটি বিশ্বব্যাপী দর্শকদের কাছে অনুরণিত হতে দেখা অবিশ্বাস্যভাবে উৎসাহব্যঞ্জক। গৌতম ঘোষ সিনেমার জগতে একজন সত্যিকারের মাস্টার, এবং এই প্রকল্পে তাঁর সাথে সহযোগিতা করা সম্মানের বিষয়। যদিও ছবিটি এখনও বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পায়নি, আমরা নিশ্চিত যে এটি শীঘ্রই আরও বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছবে এবং তার সৃজনশীল যাত্রা অব্যাহত রাখবে।”
ছবিটির প্রযোজনা যাত্রাও তুলে ধরা হয়েছিল, যেখানে গৌতম ঘোষ ঝাড়খণ্ডের গ্রামীণ পরিসরে শুটিং করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন। স্থানীয় গ্রামবাসীরা প্রায়শই অভিনেতাদের বাস্তব জীবনের গ্রামবাসী ভেবে ভুল করত। যা অভিনেতাদের কাছে একটা বড় পাওয়া। অনুকূল আবহাওয়ার কারণেও প্রযোজনাটি উপকৃত হয়েছিল, যার ফলে শুটিং নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
এম.এস. ধোনি – দ্য আনটোল্ড স্টোরি এবং সিমরান-এর জন্য পরিচিত অমিত আগরওয়াল বলেন, “রাগিরের একটি দীর্ঘ শেল্ফ লাইফ আছে, এবং এটি যে ভালোবাসা পাচ্ছে তা প্রমাণ করে যে ভালো সিনেমা সর্বদা তার দর্শকদের খুঁজে পায়। নাসিরুদ্দিন শাহের এই ছবিটি করতে রাজি হওয়া আমাকে ভবিষ্যতে আরও অর্থবহ প্রকল্প গ্রহণের অনুপ্রেরণা দিয়েছে বলে আমি কৃতজ্ঞ।”

ফ্রান্সের কনস্যুলেট জেনারেল অ্যালায়েন্স ফ্রাঁসেজ ডু বেঙ্গালে এবং নন্দন কর্তৃক আয়োজিত ফরাসি চলচ্চিত্র উৎসবে কলকাতায় প্রচুর চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে ঘরে বাইরে, খারিজ, মন্থন, লজ্জাহীন, হাজারোঁ খোয়াইশেঁ অ্যায়সি এবং মান্টোর মতো বিখ্যাত ভারতীয় মাস্টারপিস। অ্যালায়েন্স ফ্রাঁসেজ ডু বেঙ্গালের পরিচালক নিকোলাস ফ্যাসিনো গৌতম ঘোষের কাজের প্রশংসা করে বলেন, “গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্রগুলি ভারতীয় গল্প বলার ঐতিহ্য বহন করে, এবং রাগীর এমনই একটি রত্ন।” এই বছরের উৎসবে এটি উদযাপন করতে পেরে আমরা গর্বিত।”

রাগীর ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতে অসাধারণ সাড়া জাগিয়েছে। বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, মামি – মুম্বাই চলচ্চিত্র উৎসব, সিনেমাএশিয়া চলচ্চিত্র উৎসব আমস্টারডাম, কিফ – কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, আইএফএফকে – কেরালার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এবং পিআইএফএফ – পুনে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মতো মর্যাদাপূর্ণ উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে এই ছবি। ফরাসি চলচ্চিত্র উৎসব কলকাতায় প্রদর্শিত হওয়ার মাধ্যমে, রাগীর তার গৌরবময় মুকুটে আরও একটি পালক যোগ করেছে এবং বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্র প্রেমীদের সাথে সংযোগ স্থাপনের যাত্রা অব্যাহত রেখেছে।

চলচ্চিত্র থেকে ফ্যাশন, বিবিধ বিষয়ে দুই দেশের যোগসূত্র যে বেশ পুরনো, তা এ দিন উঠে আসে অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ থেকে পরিচালক গৌতম ঘোষ, অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং অন্যান্য অতিথিদের কথায়।ফরাসি চিত্র পরিচালক জঁ লুক গদার, ফাঁসোয়া ত্রুফোর নাম উঠে আসে নাসিররুদ্দিন শাহ এবং গৌতম ঘোষের আলোচনায়। তাঁরা সকলেই আশাবাদী, দেশ-বিদেশের এমন ছবি দেখার সুযোগ নষ্ট করবেন না কলকাতার চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষেরা।