দেশেরসময় , কলকাতা: আরজি করে খুন হওয়া তরুণী চিকিৎসকের দেহের কোনও হাড় ভাঙেনি, ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টের পরে গতকাল, সোমবার এমনটাই জানিয়েছিল পুলিশ। ফলে প্রাথমিক ভাবে যে তথ্য শোনা গেছিল, মৃতার কলার বোন ও পেলভিক বোন ভাঙার, তা খারিজ হয়ে যায়। তবে হাড় না ভাঙলেও, যে ধরনের আঘাত এবং তার যে বীভৎসতার কথা বলছে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, তা দেখে শিউরে উঠতে হয়। এবং সন্দেহ আরও দঢ় হয়, যে সে রাতে তরুণীর উপর একজন মাত্র নির্যাতন করেনি।
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বিস্তারিত ভাবে খুঁটিয়ে দেখে পুলিশের দাবি, ধর্ষণের আগে বীভৎস মারধর করা হয়েছিল তরুণীকে। তার পরেও তিনি প্রতিরোধ করলে, প্রবল বল প্রয়োগ করা হয়েছিল তাঁর উপর। তরুণীর বুকে আঘাত লাগে, শ্বাসরোধ করে দমবন্ধ করার প্রমাণ মিলেছে। ভেঙে যায় থাইরয়েড কার্টিলেজ, গলার হাড়েও নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। গলা টিপেই খুন করা হয়েছে ওই চিকিৎসককে। তবে নিজেকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন নির্যাতিতা।
জানা গেছে, চশমার কাচ ভেঙে চোখে গভীর ক্ষত হয় তরুণীর। অপরাধীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রবল ধস্তাধস্তিতেই কাচ ভেঙে যায় এবং চোখে ঢুকে রক্ত বেরিয়ে যায়। মাথাতেও আঘাত রয়েছে তাঁর। রিপোর্ট বলছে, ধস্তাধস্তির সময়ে নির্যাতিতার মুখ চেপে দেওয়ালে ঠুকে দেওয়া হয়েছিল মাথা। মুখে আঁচড়ের ক্ষত রয়েছে।
পাশাপাশি, তাঁর যৌনাঙ্গে গভীর ক্ষত রয়েছে। এতই ভয়ানক পেনিট্রেশন হয়, যার জেরে বিপুল রক্তপাত ঘটে এবং হাইমেন ফেটে যায়! যোনির ভিতরে ১৫০ গ্রাম বীর্য মিলেছে, যা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে পরবর্তী পরীক্ষার জন্য।
পুলিশ সূত্রের খবর, ধৃতের একার পক্ষে যে ওই ঘটনা ঘটানো কঠিন– এই তত্ত্ব এখনই উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হওয়া সঞ্জয় রায়ের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয়েছে ল্যাবে। সেই সঙ্গে ভাল করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে সমস্ত সিসিটিভি ফুটেজ।
ঘটনার দিন মদ্যপ অবস্থায় ছিল সঞ্জয়। গভীর রাতে ঘুম থেকে টেনে তুলে ওই তরুণীর ওপর ভয়ানক অত্যাচার করে সে। হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, তরুণী যে সেমিনার হলে শুয়েছিলেন সেখানে রাত ৩টের কিছু পরে ঢোকে সঞ্জয়। এরপর অন্তত ৪৫ মিনিট পর তাকে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, ঢোকার সময়ে তার কানে হেডফোন ছিল, কিন্তু বেরিয়ে আসার সময়ে ছিল না। পরে পুলিশ ওই হেডফোনের সূত্র ধরেই তাকে গ্রেফতার করে।
অন্যদিকে, এই ঘটনায় ধৃত সন্দেহভাজন সঞ্জয় রায় ইতিমধ্যেই পুলিশকে জানিয়েছে, ধর্ষণের সময়ে তরুণী চিৎকার করে সবাইকে ডেকে দিত, তাই তাঁকে খুন করেছে সে। পুলিশ সূত্রে খবর, জিজ্ঞাসাবাদের সময় সব কথা স্বীকার করেছে সে। সঞ্জয়ের ভাবভঙ্গি দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে এত বড় জঘন্য কাজ করেছে। তাই পুলিশের অনুমান, খুব ঠান্ডা মাথাতেই এই ঘটনা ঘটিয়েছে সঞ্জয়। তাই সে এখনও নির্বিকার। এমনকী ইতিমধ্যেই সে পুলিশকে বলেছে, ‘আমাকে ফাঁসি দিলে দিন’!
সোমবারের পর মঙ্গলবারেও আরজি করে অচলাবস্থা। তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় জারি রয়েছে আন্দোলন। সোমবারের পর মঙ্গলবারেও কর্মবিরতি জারি রেখেছেন চিকিৎসকরা। তবে, আন্দোলন এখন শুধু আরজি কর হাসপাতালে বদ্ধ নেই। রাজ্যজুড়ে একাধিক সংগঠন এগিয়ে এসেছেন সঠিক বিচারের দাবিতে। সোমবার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত নাগরিক মিছিল হয়।
অন্যদিকে, কলকাতা পুলিশকে রবিবার পর্যন্ত ডেডলাইন বেঁধে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নয়তো তদন্ত যাবে সিবিআইয়ের হাতে।
মঙ্গলবার সকালেও আরজি করে রোগীদের ভিড় দেখা গিয়েছে। কিন্তু এদিন নার্সরা সকালে কলেজে ঢুকলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের বেরিয়ে যেতে দেখা যায়।
সোমবার মাঝরাত পর্যন্ত এই ঘটনায় সাত জনকে জেরা করেছে কলকাতা পুলিশ। মঙ্গলবার সকালে আরজি করের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার এবং চেস্ট মেডিসিনের প্রধানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে। আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে বদলি করা হয়েছে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। সেখানেও আন্দোলন শুরু করেছেন পড়ুয়ারা। প্রশাসনিক ভবনেই তালা মেরে দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, ‘দেখি উনি কতটা প্রভাবশালী’।