আরজিকরে ডাক্তারি পড়ুয়াকে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায় কতটা বেপরোয়া ইতিমধ্যে তার টের পাচ্ছেন তদন্তকারীরা। গ্রেফতারের পরও সঞ্জয় নির্লিপ্তভাবে তদন্তকারীদের বলেছিল, “ফাঁসি দিয়ে দিন!”
তদন্তে নেমে সিটের কর্তারা জানতে পারছেন, সামান্য সিভিক ভলান্টিয়ার হয়েও পুলিশের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব ছিল সঞ্জয়ের।
কলকাতা পুলিশ ওয়েলফেয়ার অ্যসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত ছিল অভিযুক্ত। জানা যাচ্ছে, কলকাতা পুলিশের কোনও কর্মী হাসপাতালে ভর্তি হলে, তাঁর চিকিৎসার বিষয়ে যাবতীয় দেখভালের দায়িত্ব থাকত সঞ্জয়ের ওপরে!
শুধু তাই নয়, সঞ্জয়কে দেখা যেত ‘কলকাতা পুলিশ’ লেখা মোটর বাইক নিয়ে ঘুরতে। জিজ্ঞেস করলে বলতো, ‘এটা আমার অফিসের।’
সামান্য সিভিক ভলান্টিয়ার হয়েও পুলিশের অভ্যন্তরে সঞ্জয়ের এত প্রভাব কীভাবে, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে সিট সূত্রের খবর। মনে করা হচ্ছে, পুলিশের অভ্যন্তরের ওই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আরজিকরেও দাপট চলতো সঞ্জয়ের। তা না হলে মাঝরাতে একজন সিভিক ভলান্টিয়ার আরজি করের চারতলার সেমিনার হলে যেতে পারতেন না বলেও মনে করছেন তদন্তকারীরা।
প্রসঙ্গত, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী ডাক্তারের ধর্ষণ ও খুন নিয়ে ইতিমধ্যেই কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “আমি মামলাটি ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। যদিও আমি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে নই, তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজনে অভিযুক্তদের ফাঁসি দেওয়া হবে। তাদের কঠোরতম শাস্তি পাওয়া উচিত।”
ধৃত স়্জয়ের দিদিও রবিবার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আরজিকরে ও(সঞ্জয়) যে নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছে তাতে ওর কঠোরতম শাাস্তি হওয়া উচিত। তবে সকলের কাছে একটাই অনুরোধ, আপনারা ওকে নিয়ে যা খুশি করুন, দয়া করে ওর দেহ আমাদের দেবেন না। আমরা নেব না। কারণ, এমন মানুষের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখা যায় না।”
রবিবার সন্ধ্যায় আরজি করে কলকাতার পুলিশ কমিশনার বা সিপি বিনীত গোয়েল। সিপি বলেন, “পড়ুয়াদের কাছে অনুরোধ, আপনাদের কাছে কোনও খবর থাকলে, কেউ জড়িত আছে মনে করলে আমাদের জানান। আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখব। কিচ্ছু লোকানোর নেই।” সিপির দাবি, এখন নানারকমের গুজব চলছে চারদিকে। বিনীত গোয়েলের কথায়, “একাধিক লোক যুক্ত বলছে কেউ, বলা হচ্ছে কাউকে আড়ালের চেষ্টা চলছে। তিনজনের সিমন পাওয়া গিয়েছে বলে নানা গল্প ঘুরছে। এগুলো একেবারেই গুজব। আমরা তদন্তে নিয়ে একেবারেই স্বচ্ছতা বজায় রাখছি।যদি কারও কোনও প্রশ্ন থাকে, আমাদের কাছে যোগাযোগ করতে পারেন।
এদিন বারবারই বিনীত গোয়েল দাবি করেন, কোনও গুজবে কান না দিতে। যে কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে তাঁরা প্রস্তুত। তাঁর কথায়, “আমরা একটা হেল্পলাইন নম্বর চালু করে দেব, সেখানেও ফোন করে কারও কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। পরিচয় গোপন রেখে অভিযোগ জানানো যাবে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ইমেল আইডিও দেওয়া হবে।”
হাসপাতালে কোথায় কোথায় সিসি ক্যামেরা বসবে, কোথায় নিরাপত্তা রক্ষী থাকবে সমস্তটাই এদিন খতিয়ে দেখেন কলকাতা পুলিশের দুই অফিসার। এদিকে এদিন চিকিৎসক ছাত্রী খুনের পরও নিরাপত্তায় গলদের অভিযোগ ওঠে। রবিবার ইএনটি ওটি’র সামনে কয়েকজন মত্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সিস্টারের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। সিপি’র সঙ্গে বৈঠকে এই অভিযোগ জানান আন্দোলনকারীরা। এরপরই আরজি করে দায়িত্বপ্রাপ্ত এসিপি’কে সরানোর দাবি জোরালো হয়।
পাঁচ বছর আগে এনআরএস কাণ্ডের পর শহরের প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে এসিপি পদমর্যাদার আধিকরিক দায়িত্ব পান। এরপরও হাসপাতালের সেমিনার কক্ষে চিকিৎসক ছাত্রী কীভাবে এমন নৃশংসতার শিকার হলেন, সেই প্রশ্ন তুলেছিল টিভি নাইন বাংলা। শেষ পর্যন্ত আরজি করের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসিপিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন পুলিশ কমিশনার।
পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, “এখন বিভিন্ন ধরনের গুজব চারদিকে চলছে। কোথাও বলা হচ্ছে একাধিক ব্যক্তি জড়িত রয়েছেন, কোথাও বলা হচ্ছে কাউকে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে, কোথাও বলা হচ্ছে তিন জনের সিমেনের নমুনা পাওয়া গিয়েছে— এমন একাধিক গুজব ছড়াচ্ছে। এ সব নিয়ে আন্দোলনকারীদের মনেও প্রশ্ন ছিল। সেগুলি নিয়ে কথা হয়েছে তাঁদের সঙ্গে। আমরা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ। যদি কারও কোনও প্রশ্ন থাকে, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।”
পুলিশ কমিশনার শনিবারই জানিয়েছিলেন, স্বচ্ছ ভাবে তদন্ত করা হবে। রবিবার আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে দেখা করে সেই একই কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, “যদি কেউ সন্দেহ করেন, ঘটনায় অন্য কেউ জড়িত থাকতে পারেন— সেটি আমরা সবরকম গুরুত্ব দিয়ে দেখব। আমাদের কিছুই আড়াল করার নেই।” তিনি জানান, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ইতিমধ্যেই পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজের বিষয়েও কথা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের যে গাইডলাইন রয়েছে, সেটি ভাঙা যাবে না।