২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করার বার্তা দিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
রবিবাসরীয় একুশের মঞ্চ বুঝিয়ে দিল, তৃণমূলের শীর্ষ স্তরের রসায়নে কোনও বদল তো ঘটেইনি। বরং আগামী দিনে সংগঠনের রাশ আরও শক্ত হাতে ধরতে চলেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং তাঁর পৌরোহিত্যেই স্মরণকালের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বড় রদবদল হতে চলেছে তৃণমূলে। সেই রদবদল হবে সংগঠনে, তা হবে পুরসভায় এমনকি পঞ্চায়েত-জেলা পরিষদেও।
এদিন ধর্মতলার সভা মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিষেক বলেন, “আমি আগেই বলেছিলাম, ভোটে কার কী ভূমিকা রয়েছে তা দল কিন্তু খতিয়ে দেখবে। গত দেড় মাস আপনারা আমাকে কোনও সংগঠনের কাজে দেখতে পাননি। কারণ আমি পর্যালোচনা ব্যস্ত ছিলাম। তিন মাসের মধ্যে তার ফল দেখতে পাবেন”। অভিষেকের কথায়, “আমি এক কথার ছেলে। কথা দিয়ে কথা রাখি।”
লোকসভা ভোটের পর চিকিৎসার কারণে সংগঠনের কাজ থেকে সাময়িক বিরাম নিয়েছিলেন অভিষেক। বিদেশে গিয়েছিলেন তিনি। গত ১৯ জুলাই কলকাতায় ফিরেছেন। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে গত দুদিনে একুশের সভার প্রস্তুতি দেখতে একবারও যাননি অভিষেক। এদিন বেলা ঠিক ১২টা নাগাদ ধর্মতলায় পৌঁছে যান।
তার পর তাঁর আধ ঘণ্টার বক্তৃতার মধ্যে অনেকটা সময় ধরে দলের উদ্দেশে বার্তা দেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। অভিষেক বলেন, “পঞ্চায়েতে যাঁরা দায়িত্বে রয়েছেন, পুরসভায় যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁদের কর্মীদের কথা ভাবতে হবে। শুধু নিজের কথা ভাবলে চলবে না। পুরসভা ভোটে আপনি কাউন্সিলরের টিকিট পাবেন, জিতবেন, আর লোকসভা ভোটে আপনার জায়গায় দল আশানুরূপ ফল করবে না, আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে দল। তা সে যত বড় নেতার ছত্রছায়ায় থাকুন না কেন।”
এবার লোকসভা ভোটে গ্রামে ভাল ফল করলেও শহরাঞ্চলে বহু জায়গায় বিজেপির থেকে পিছিয়ে রয়েছে তৃণমূল। কলকাতা, বিধাননগরের মতো পুরসভা তো বটেই বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মতো বহু জেলায় পুরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ডে তৃণমূল পিছিয়ে রয়েছে। তার পর মমতা ও অভিষেকের থেকে একটা কড়া পদক্ষেপ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এদিন তারই পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছেন অভিষেক।
একুশের মঞ্চে তিনি বলেন, “পঞ্চায়েতে আপনি টিকিট পাবেন, আপনি আপনার ভোটে জিতবেন। আর বিধানসভা ভোটে ভাববেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে একটা মিটিং করবেন আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এসে একটা মিটিং করবেন আর দল জিতে যাবে, এরকম চলবে না। নিজের ভোটের জন্য গায়ে গতরে যতটা পরিশ্রম করবেন, সব ভোটের জন্য ততটাই পরিশ্রম করতে হবে।”
অভিষেক আরও স্পষ্ট করে দেন, কোনও পুরসভায় তৃণমূল পিছিয়ে থাকলে সেখানে শুধু চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নেবে তা নয়। টাউন সভাপতির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবার পঞ্চায়েতে পিছিয়ে থাকলে শুধু গ্রাম প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। ব্লক সভাপতির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দল যে এই ব্যবস্থা নিতে চলেছে, সেই বার্তা যাতে মানুষের কাছে পৌঁছয় এদিন সেকথাও কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। তাঁর কথায়, আমি যেভাবে বললাম, গ্রামের মানুষকে গিয়ে বলবেন।”
অভিষেক এদিন আরওবললেন, ‘‘যাঁরা নতুন, তাঁদের ২১ জুলাইয়ের ইতিহাস, তৃণমূলের লড়াই এবং নেত্রীর লড়াই সম্পর্কে জানতে হবে। আর যাঁরা পুরনো রয়েছেন, তাঁদেরকেও নতুনদের সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলকে শক্তিশালী করার জন্য মাঠে নেমে লড়াই করতে হবে। সামঞ্জস্য রেখে করতে হবে। পুরনোদের অভিজ্ঞতা আর নতুনদের উৎসাহ-উদ্দীপনা তৃণমূলের একই বৃন্তে দু’টি কুসুম।’’
শৃঙ্খলাপরায়ণ হতে হবে— দলের কর্মীদের বার্তা অভিষেকের। বললেন, ‘‘তৃণমূলের কর্মীরাই তৃণমূলের শক্তি। আমাদের কর্মীদের সংযত হতে হবে। কোনও রকম বাগ্বিতণ্ডায় জড়াবেন না। বিজেপিকে ভোট দিয়ে মানুষ জেতাননি, মানুষ আপনাদের ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন। তার কারণ, আপনার পাড়া আপনার এলাকায় আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই মানুষগুলো বিশ্বাস করেছেন। বিজেপির কর্মীদের বিশ্বাস করেননি। আমাদের সংযত থাকতে হবে।’’
কালীঘাটের ঘনিষ্ঠ সূত্রে খবর, লোকসভা ভোটের পর জেলা, ব্লক ও পুরসভা ধরে ধরে ফলাফলের বিশ্লেষণ করেছে তৃণমূল। তার পর আইপ্যাককে দিয়ে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। ভোটে কোন নেতার কী ভূমিকা ছিল তা সেই সমীক্ষায় ধরা পড়েছে। সম্ভবত সেই সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে এবং সংগঠনের থেকে রিপোর্ট নিয়ে রদবদল করা হবে।
এদিন অভিষেক তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন ২৪ মিনিটের মাথায়। তবে বক্তৃতা শেষের আগে দলে নবীন এবং প্রবীণদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করার বার্তাও দিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
এদিনের সভার পর কাল দিল্লি যেতে পারেন অভিষেক। সংসদের বাজেট অধিবেশনে উপস্থিত থাকবেন তিনি। এরই মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও দিল্লি যাওয়ার কথা। সম্ভাব্য রদবদল নিয়ে সেখানেই দিদি ও অভিষেকের দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।