একটা সময়ে ঘাসফুল শিবিরের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বাগদা বিধানসভা কেন্দ্রে ২০১৬ সাল থেকে বিধানসভা ও লোকসভা ভোটে তৃণমূলের ভরাডুবি হয়ে আসছে। এ বার লোকসভা ভোটে ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া তৃণমূল। তারই প্রস্তুতি হিসেবে তৃণমূলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রবিবার সভা করলেন বাগদায়।
বনগাঁর প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ, অধুনা রাজ্যসভার সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরকে হরিচাঁদ এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামে শপথগ্রহণে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে তৃণমূলের অভিযোগ। এই প্রসঙ্গে রবিবার অভিষেক বলেন, “যাঁরা শ্রী শ্রী হরিচাঁদ, শ্রী শ্রী গুরুচাঁদকে ঈশ্বর বলে মানেন না, তাঁদের কি ভোট দেবেন?”
রবিবার বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের বাগদা ব্লকের হেলেঞ্চা হাই স্কুলের মাঠে জনসভা থেকে প্রশ্ন তুললেন তৃণমূলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ।
এদিন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে বাগদার জনসভা থেকে বিজেপিকে তোপ দাগলেন অভিষেক। তিনি বলেন, “নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পাঁচ দিন আগে এরা নাগরিকত্ব দেবে বলে ফর্ম নিয়ে এসেছিল। আজ দু’মাস কেটে গেল। এরা (বিজেপি) বলেছিল, তৃণমূল চায় না আপনি নাগরিকত্ব পান। বলুন তো আপনারা, এই দু’মাসে তৃণমূল কাউকে ফর্ম ফিল আপ করা থেকে আটকেছে? আটকায়নি। কিন্তু আপনি আমায় দেখান, বিজেপির কোনও বুথের কোনও নেতা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন।”
কয়েক দিন আগেই নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জে সভা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, মতুয়ারা শরণার্থী। সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অভিষেক বলেন, “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সভা করে বলে গিয়েছেন মতুয়ারা শরণার্থী। আর আমরা বলছি মতুয়ারা সবাই দেশের নাগরিক। এটাই পার্থক্য।”
বিদায়ী সাংসদ হিসাবে শান্তনু ঠাকুরের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই আসনে প্রার্থীদের জয়পরাজয়ের ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় মতুয়া ভোট। সে কথা মাথায় রেখে অভিষেক বলেন, “এই শান্তনু ঠাকুর গত পাঁচ বছরে মতুয়া ভাইদের জন্য কী করেছেন?”
গত পঞ্চায়েত ভোটে নিজের বুথে হেরেছেন। সে কথা উল্লেখ করে অভিষেকের আর্জি, আগামী ২০ মে ভোট দিয়ে শান্তনুকে ‘শেষ জবাব’ দিন।
এদিনের জনসভা থেকে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প নিয়ে বিজেপিকে তোপ দাগেন তৃণমূলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক । বিজেপি তাদের অধীনস্থ রাজ্যগুলিতে এই প্রকল্প চালু করলে তিনি আর তৃণমূলের হয়ে ভোট চাইবেন না বলেও দাবি করেন অভিষেক।
তিনি আরও বলেন,বিজেপি ক্ষমতায় এলে ২০২৯ সালে রান্নার গ্যাসের দাম আড়াই হাজার টাকা হয়ে যাবে বলে দাবি করলেন অভিষেক। বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ ক্ষমতায় এলে দেশে ৫০ কোটি মহিলাকে লক্ষ্মীর ভান্ডার দেওয়া হবে বলেও দাবি করেন তিনি। একই সঙ্গে অভিষেক জানান, দারিদ্রসীমার নীচে থাকা পরিবারকে বছরে দশটি গ্যাস সিলিন্ডার বিনামূল্যে দেবে ‘ইন্ডিয়া’র সরকার।
অভিষেক জানান, বাগদায় দলের প্রার্থী কে হবেন, তা স্থির করবেন মানুষই। তাঁর কথায়, এই মাঠেই আমি আবার জুলাই মাসে সভা করতে আসব। নবজোয়ারে যে ভাবে আপনাদের মতামত নিয়ে প্রার্থী করেছি, সে ভাবেই ৫০ হাজার মানুষের মতামত নিয়ে আমরা প্রার্থী ঠিক করব।” প্রসঙ্গত, বনগাঁর তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস বাগদা কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন। প্রার্থী হওয়ার পর বিধায়ক পদে ইস্তফা দেন তিনি। ফলে এই কেন্দ্রে উপনির্বাচন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।
রবিবার বাগদা ব্লকের হেলেঞ্চা হাই স্কুলের মাঠের জনসভা থেকে সিএএকে সমর্থন করতে শর্ত দিলেন অভিষেক। বনগাঁর জনসভায় তিনি বলেন, “বিজেপির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর প্রধানমন্ত্রী এসে যদি ঘোষণা করেন যে, আমরা নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেব, কোনও এনআরসি হবে না, তা হলে তৃণমূলের কেউ সমর্থন করুক আর না করুক, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সমর্থন করবে। আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি।” একই সঙ্গে অভিষেকের দাবি, সিএএ-র পর এনআরসি চালুর দিকে এগোবে বিজেপি।
রাজনৈতিক মহলের অনেকে মনে করছেন, বাম আমলে, ২০০৬ সালে গোটা রাজ্যে তৃণমূলের ভরাডুবির মধ্যেও বাগদা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন দুলাল বর। বাম আমলেই ২০০৩ সালে বাগদা পঞ্চায়েত সমিতি দখল করেছিল তৃণমূল। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটেও জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী, প্রাক্তন সিবিআই কর্তা উপেন বিশ্বাস। তৃণমূলের এখানে ভরাডুবি শুরু হয় ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোট থেকে। সে বার দুলাল বর কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে দাঁড়ান। বামেরা কংগ্রেস প্রার্থী দুলালকে সমর্থন করে। ভোটে জিতে যান দুলাল।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বাগদা থেকে বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর ২৪,৪৫৭ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন। ২০২১ সালে বাগদা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস ৯,৭৯২ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। সেই বিশ্বজিৎ পরবর্তী সময়ে তৃণমূলে যোগদান করেন। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিশ্বজিৎকে দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি পদে বসান। তাঁকেই এবার লোকসভা ভোটে প্রার্থী করেছে দল।
পর পর ভোটে এখানে তৃণমূলের ভরাডুবির কারণ হিসেবে গোষ্ঠীকোন্দলকে দায়ী করেন দলেরই অনেকে। তা ছাড়া, নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে এখানে। তবে জেলা সভাপতি হওয়ার পর থেকে বিশ্বজিৎ বাগদার সব নেতানেত্রীদের এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা শুরু করেন। এখন প্রকাশ্যে কোন্দল অনেকটা মেটানো গিয়েছে বলেই নেতৃত্ব মনে করছেন।
বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত যে সাতটি বিধানসভা আছে, তার মধ্যে সব থেকে বেশি মতুয়া এবং উদ্বাস্তু সমাজের মানুষের বাস বাগদা বিধানসভা এলাকাতেই। নাগরিকত্বের বিষয়টি এখানে ভোটে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে বলে রাজনৈতিক মহলের অনেকে মনে করছেন। মতুয়া ভোট এখানে গুরুত্বপূর্ণ বরাবরই। মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষের দীর্ঘ দিন দাবি ছিল নাগরিকত্বের।
সম্প্রতি কেন্দ্র সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধিত আইন) কার্যকর করার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। তারপর থেকে মতুয়া-উদ্বাস্তু সমাজ কার্যত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। মতুয়াদের একাংশের দাবি, তাঁরা নিঃশর্ত নাগরিকত্ব চেয়েছিলেন। কিন্তু সিএএ-তে নিঃশর্ত নাগরিকত্বের ব্যবস্থা নেই। এখানে আবেদনের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের কথা উল্লেখ আছে। ফলে তাঁরা সিএএ আইন বাতিলের দাবি তুলেছেন।
তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, অভিষেক মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষদের এই বার্তাই দিতে এসেছেন যে, নাগরিকত্বের আবেদন করলে মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষেরা বে-নাগরিক হয়ে যাবেন। পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের পাশে আছেন। কেউ তাঁদের এখান থেকে তাড়াতে পারবে না।
বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘‘সাংগঠনিক ভাবে এ বার আমরা বাগদা থেকে লিড পাচ্ছিই। অভিষেকের সভা আমাদের লিডের সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে।’’
যদিও অভিষেকের সভাকে কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না বিজেপি। দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি দেবদাস মণ্ডল বলেন, ‘‘ বাগদার মানুষ মনস্থির করে নিয়েছেন, গদ্দার বিশ্বজিৎ দাস কে ১ লক্ষ ভোটের ব্যবধানে এখান থেকে হারাবেনই।’’