সৃজিতা শীল, কলকাতা: গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ২০০৩ সালে রোমের যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের উল্লেখ আছে। ওই যুদ্ধ-বিরোধী মিছিলে ১৫ লক্ষ মানুষ পা মিলিয়েছিলেন।
২০১৯ সালের অক্টোবরে ইরাকের কলেজ পড়ুয়াদের আন্দোলনের জেরে স্বেচ্ছায় গদি ছাড়তে হয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আদেল আব্দুল মাহদিকে। তখন আন্দোলনের বয়স ছিল আড়াই বছর। এছাড়া খুব বেশিদিন ধরে চলেছে এমন আন্দোলনের নজির রয়েছে ফ্রান্স ও হংকংয়ে। গোটা বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নাম উঠেছে ভারতের কৃষক আন্দোলনেরও।
নাগরিকত্ব আইন নিয়েও ভারতের আন্দোলন বহু মানুষকে একত্রিত করেছিল। তবে সক্রিয়তার নিরিখে সেই আন্দোলনের বয়স মেরেকেটে ৫ মাস।
আর এদিকে ধর্মতলায় গান্ধীমূর্তির পাদদেশে বাংলার শিক্ষক নিয়োগের আন্দোলন যা শনিবার সহস্র দিনে পা দিল। এদিন বিক্ষোভ ও আন্দোলনের পারদ আরও চড়াতে রাসমণি পাত্র নামে এক চাকরিপ্রার্থী মাথা মুড়িয়ে ফেলেন। তা দেখে সহানুভূতি জানাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপি নেতারা।
পরিস্থিতি যখন এমনই, তখন বিকেল সওয়া ৩টে নাগাদ দেখা যায় আন্দোলনকারীদের মঞ্চে পৌঁছে গিয়েছেন কুণাল ঘোষ। সেখানে পৌঁছেই কুণাল বলেন, “আমি ক্যামেরায় মুখ দেখাতে আসিনি। ন্যাড়া হচ্ছেন দেখে খারাপ লাগল তাই এসেছি। তা ছাড়া চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি দেওয়ার একটা কথা চলছে।” কিন্তু কুণাল তাঁর কথা শেষ করার আগেই চার পাশ থেকে চোর চোর স্লোগান উঠতে শুরু করে।
কুণালকে ঘিরে এরকম উত্তেজনা তৈরি হওয়ায় পরিস্থিতি কিছু বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তখন আবার বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুও সেখানে হাজির ছিলেন। কুণালের নাম না করে তিনি বলেন, “এক হাজার দিন অতিক্রান্ত। এতদিন সরকারের প্রতিনিধিদের টনক নড়েনি। মাথা ন্যাড়া হতে টনক নড়ল!”
বিমানের কথায় কিছুটা উজ্জীবিত হন চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ। তাঁরাও কুণালের উদ্দেশে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। বলেন,”এতদিন কোথায় ছিলেন? সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে এখন আর কোনও কথা নয়।”
ওদিকে কুণালের রাজনৈতিক ধারাও পালিয়ে যাওয়া নয়। দেখা যায়, তিনি সেই বিরোধিতার মুখে পড়েও আন্দোলনকারীদের মধ্যে বসে পড়েন। তার পর সেখান থেকে ফোন লাগান শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে।
এদিন মাথা ন্যাড়া করার পর রাসমনি পাত্র বলেন, “এমএ পাশ করেছি। বিএডও করেছি। চাকরির পরীক্ষায় পাশ করেছি। তারপরও চাকরি মেলেনি”। হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকেন রাসমণি। সেই সঙ্গে বলেন, “বাড়িতে বৃদ্ধ মা, বাবা, অসুস্থ ছেলে। চাকরির আশায় টানা ১ হাজার দিন ধরে প্রতিদিন সকাল ১১ টা থেকে সন্ধে ৬ টা পর্যন্ত অবস্থান মঞ্চে আসছি। কিন্তু আর পারছি না। বাধ্য হয়ে মাথা ন্যাড়া করলাম। মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। জানতে চাই, কী করলে হকের চাকরি পাব?”
ওই মহিলা চাকরিপ্রার্থী ছাড়াও চাকরির দাবিতে মাথা ন্যাড়া করছেন এসএলএসটি চাকরিপ্রার্থীরাও। পুরুষ চাকরিপ্রার্থীরা এদিন জামা খুলে ধর্নায় বসেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য, “এক হাজার দিন অতিক্রান্ত। এখনও চাকরি মিলল না। এরই বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ।”
পর্যবেক্ষকদের মতে, কুণাল শাসক দলের প্রতিনিধি হয়েও যে ধর্না মঞ্চে গিয়েছেন তা একেবারে হয়তো কৌশলগত। কারণ, শাসক দলের প্রতিনিধিই যদি সেখানে থাকেন তাহলে বিরোধীদের জন্য পরিসর কমে যায়। কিন্তু তা কতটা কাজে লাগল সেই প্রশ্নও তৃণমূলের মধ্যেই উঠেছে। কারণ, দিনের শেষে শাসক দল বা সরকার চাকরি দিতে না পারলে এই সব ক্ষণিকের কৌশল কোনও কাজে লাগবে না।
প্রসঙ্গত, গোটা রাজ্য থেকে মানুষ ধর্মতলা আসেন কাজের জন্য। কেন্দ্রীয় সরকারি বেশিরভাগ অফিস এখানেই। হাইকোর্ট থেকে শুরু করে রাজ্যেরও একাধিক দফতরের ঠিকানা ধর্মতলা। তবে কিছু মানুষ রোজ কাকভোরে আসেন ধর্মতলার ধরনাতলায়।
ট্রেন-বাস, তারপর পায়ে হেঁটে সকাল ১১ টার মধ্যে ‘হাজিরা’ দিতে হয় মেয়ো রোডের গান্ধীমূর্তিতে। এরা জানেন না কতদিনে এই হাজিরা খাতা বন্ধ হবে। তবে এটা জানেন, চাকরিটা না পাওয়া পর্যন্ত এই হাজিরা খাতায় সই করা বাধ্যতামূলক। নাহলে, আবার যদি কেউ তাদের মুখের গ্রাসটা কেড়ে নেয়। তাই তাঁরা রোজ আসেন।
শরীর-মন অবশ হয়ে এলেও তাঁরা আসেন। শনিবার ১,০০০ দিনে তাঁদের অভিনব প্রতিবাদের সাক্ষী থেকেছে গোটা রাজ্য। কতজন যে আজ কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে মাথা ঠুকেছেন, এত ভিড়ে ওই হিসেবটা ঠিক করা যায়নি। তবে এটুকু বলা যায়, ২০১৯ সালের আন্দোলন আজ অনেকের মতেই ‘ঐতিহাসিক’ তকমা পেয়েছে। গবেষণা বলছে, গোটা বিশ্বে যত আন্দোলন হয়, তার মাত্র ২৩ শতাংশ ৩ মাসের গণ্ডি পেরতে পারে। সেখানে বাংলার শিক্ষক নিয়োগের আন্দোলন ৩ বছরের পথে। যাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গে আন্দোলনটাকে এতদিন চালিয়ে গেলেন তাঁদের জীবনের কাহিনি শুনলে বোঝা যাবে সমস্যা ঠিক কত ধরনের হয়। যা অনেকেই হয়ত কল্পনাও করতে পারেন না।
এই ধরুন গঙ্গারামপুরের রেহেসান আলির কথা। বয়স ৩৬। বাবা অসুস্থ। কষ্ট করে যে বাবা-মা রেহেসানকে নেট পাশ করিয়েছেন, সেই বাবা-মাকে মাসে ১ টাকাও তুলে দিতে পারেন না রেহেসান। উল্টে আন্দোলনে যোগ দিতে আসার জন্য বাবার কাছেই হাত পাততে হয় তাঁকে। লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে এলেও উপায় নেই। রেহেসান জানেন না কবে চাকরি হবে।
বাবার খুব ইচ্ছে পুত্রবধূ দেখবেন, কিন্তু যে পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সেখানে ইচ্ছের কি কোনও দাম আছে? দিনহাটার প্রণব অবশ্য মাথার ওপর ছাতার মতো পেয়েছিলেন দাদাকে। দিনকয়েক হল দাদা আর নেই। সংসারের বেহাল দশা। তবু প্রণবের কিচ্ছু করার নেই। শুধু রোজ বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজে বলেন, ইসস্, যদি চাকরিটা থাকত!
কোচবিহারের সিতাই থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে কলকাতা আসেন পরভিনা। পরভিনা টিউশন পড়ান। যা টাকা আসে, তা কলকাতার আন্দোলনে আসতেই শেষ। সংসার, সন্তানের জন্য কিছু করার ইচ্ছে থাকলেও উপায় কই? একই জেলার মারুফা বানুর সমস্যা তো যে কোনও সমাজবিজ্ঞানের গবেষকের কাছে নিঃসন্দেহে একটা থিসিস পেপার হতে পারে।
এই যে তিনি কলকাতা আসেন, পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেন, তা ভাল চোখে দেখে না তাঁর গ্রাম। বাড়ির স্ত্রী হয়ে কেন প্রতি মাসে শহরে ছুটে আসা? এই প্রশ্নের উত্তরের চেয়েও তাঁকে বেশি ভাবায় তাঁর ছোট্ট ছেলের আবদার। সে শুধু একটা ঘড়ি আর ব্যাগ চেয়েছিল। মারুফা তা দিতে পারেননি। একজন মায়ের কাছে এর চেয়ে বেশি কষ্টের আর কী হতে পারে।
এরকম হাজারো না পারার কাহিনি বলতে শুরু করলে হয়তো মন খারাপের দিস্তা দিস্তা দলিল তৈরি হবে। কিন্তু প্রত্যেকটা গল্প নিষ্ঠুর হলেও সত্যি। আজ হাজার দিনে অবস্থান মঞ্চে তিল ধারনের জায়গা ছিল না। একটা ছোটখাটো সর্বদল সমন্বয়ও হয়ে গিয়েছে ধরনামঞ্চে। আজ ছিল নেতাদের আগে গিয়ে রাসমণির পাশে বসার সুপ্ত প্রতিযোগিতা। রাসমণি কে? রাসমণি শিক্ষাবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। বিএড পাশ করে অপেক্ষমান মেধা তালিকায় নাম তোলার পরও আজ তাঁকে হকের চাকরির জন্য নিজের মাথা ন্যাড়া করতে হয়েছে।
হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ১০-১২ টা ক্যামেরার সামনে নাপিত ডেকে মাথা মুড়িয়েছেন ‘শিক্ষিত বেকার’ রাসমণি পাত্র। ক্যামেরার সামনে তিনি চোখে জল নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলেছেন, “যে জীবনের কোনও দাম নেই, সেখানে চুলের সৌন্দর্য রেখে হবেটা কী!” নাপিত যখন ক্ষুর দিয়ে রাসমণির মাথা কামাচ্ছিলেন, খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি এত ক্যামেরা দেখে তাঁর হাত কাঁপছিল। অন্য মহিলা চাকরিপ্রার্থীরা তখন হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন। এই কান্না ‘মেকি’ বা ক্যামেরা আকর্ষণের জন্য নয়।
এই চাকরিপ্রার্থীদের অনেকের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। বেকার স্বামীর সঙ্গে মেয়েকে আর ঘর করতে দিতে চান না, এমন বাবার আবদার শুনে ময়দানে বসে থাকা চাকরিপ্রার্থীকেও দেখেছি। চাকরিটা হলে বাবার চিকিৎসা হবে, এই আশায় দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসকের খোঁজ নেওয়া চাকরিপ্রার্থীকেও চিনি।
এমন প্রেমিক চাকরিপ্রার্থীকে চিনি, যিনি অনেক ঝগড়া করে চাকরি হওয়া পর্যন্ত প্রেমিকার বিয়েটা কোনওরকমে আটকে রেখেছেন। এত কিছুর পরেও সব হচ্ছে, শুধু চাকরিটা ছাড়া।
আপনারা তো শিক্ষিত, চাইলে অন্য কিছুও তো করা যায়? প্রশ্নটা শেষপর্যন্ত করতেই হল। চোখের জল লুকিয়ে উত্তর এল। সুন্দরবনের এক অজপাড়া গাঁয়ের মহিলা চাকরিপ্রার্থী বললেন, ‘মেয়ে বলেছে মা তোমাকে দিদিমণি হতেই হবে।’ আসলে এঁদের প্রত্যেকের মাথায় শিক্ষক হওয়ার ‘ভূত’ চেপেছে। ভূত-ই। আর তা পুলিশের লাঠিতে নামবে না। আন্দোলনের ১০০০তম দিনে তা যেন আরও স্পষ্ট হল।