দেশের সময়: তৃণমূলের নবজোয়ার কর্মসূচিকে ঘিরে গত রবিবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ঠাকুরনগর। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে পৌঁছতেই শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ। তিনি ঠাকুরনগর থেকে বেরিয়ে আসার পরও মতুয়াদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সেই ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হন। আহতদের সঙ্গে দেখা করতেই মঙ্গলবার ঠাকুরনগরে যান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। আহতদের সঙ্গে দেখা করার পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর ও বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও করেন তিনি।
ঘটনার দিনই তীব্র নিন্দা করে টুইট করেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন বঙ্গ-বিজেপিতে ব্রাত্য থাকার পর ঠাকুরনগরে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে টক্কর নিয়ে শান্তনু ঠাকুর এখন দলের নয়নের মণি হয়ে উঠেছেন বলে মনে করছেন অনেকেই ৷ ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পরেও দিল্লি থেকে দলের তাবড় নেতারা তাঁকে ফোনে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। বিজেপির নিচুতলার কর্মীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তারিফ করছেন। রাতারাতি বঙ্গ-বিজেপিতে তাঁর গুরুত্ব বাড়ার বিষয়টি রীতিমতো উপভোগ করছেন বনগাঁর সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর।
রবিবার ঠাকুরনগরে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরের গেটে শান্তনুর নেতৃত্বে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। যাতে মন্দিরে ঢুকতে না পারেন অভিষেক। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রীতিমতো হাতাহাতিও হয় দু’পক্ষের। গেরুয়া শিবিরের একাংশের ব্যাখ্যা, তৃণমূলের দীর্ঘ জনসংযোগ যাত্রায় বিজেপি নেতারা অভিষেককে আক্রমণ করলেও শান্তনুর মতো কেউ পথ আগলে দাঁড়াতে পারেননি।
এই ঘটনা পঞ্চায়েত ভোটের মুখে বিজেপির নিচুতলার নেতা-কর্মীদের মনোবল একধাক্কায় অনেকটাই বাড়িয়ে দেবে। নিচুতলার বিজেপি নেতা-কর্মীদের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টেও তার ইঙ্গিত মিলেছে। সেখানে শান্তনুর মতো ‘লড়াকু নেতা’কে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বর সামনের সারিতে আনার দাবিও উঠতে শুরু করেছে। পার্টি কর্মীদের মনোভাব টের পেয়ে মঙ্গলবার সকালে নন্দীগ্রামে দলীয় কর্মসূচি সেরে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী হাজির হন ঠাকুরনগরে শান্তনুর বাড়িতে।
সেখানে বেশ কিছুক্ষণ একান্তে বৈঠকও হয় দু’জনের। শান্তনুর তারিফ করেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষও। তাঁর কথায়, ‘শান্তনু ঠাকুর দারুণ কাজ করেছেন। তিনি মতুয়া সমাজের হিরো। মতুয়াদের ভাবাবেগ রক্ষা করার জন্য যা ঠিক মনে করেছেন, করেছেন।’ শান্তনু নিজে অবশ্য বলছেন, ‘আমি কোনও হিরো নই। আমার পূর্বপুরুষও মতুয়া সমাজের ভাবাবেগ রক্ষা করার জন্য লড়াই করেছেন। অভিষেকবাবু জানিয়ে এলেই কোনও সমস্যা হতো না।’
এই শান্তনুই কিন্তু এতদিন কাঁটার মতো বিঁধে ছিলেন বঙ্গ-বিজেপিতে। দলের বর্তমান রাজ্য নেতৃত্বর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশও করেছিলেন। ২০২১-এর বিধানসভার পর শান্তনু দলের বিদ্রোহী শিবিরের সঙ্গে কলকাতায় পোর্ট ট্রাস্টের গেস্ট হাউসে বৈঠক করেছিলেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বর উপর কার্যত অনাস্থা প্রকাশও করেন।
সিএএ নিয়েও তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। সূত্রের খবর, শান্তনুর কার্যকলাপে দলের ক্ষতি হচ্ছে, এই মর্মে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বর কাছে সেই সময়ে দফায় দফায় অভিযোগ জমা পড়েছিল রাজ্য বিজেপির দপ্তর থেকে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার পরে শান্তনুর ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হলেও রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বকে তিনি এড়িয়েই চলতেন। সুকান্ত মজুমদারদের সঙ্গে দলীয় বৈঠকে অংশ নিতে শান্তনু এখনও কলকাতা আসেন না। রবিবার ঠাকুরনগরের ঘটনা অবশ্য বিজেপির অন্দরের সব সমীকরণ উল্টে দিয়েছে।
এদিন শুভেন্দু অভিযোগ করেন, তৃণমূলের নবজোয়ার কর্মসূচির জেরেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে। এর ফলে ঠাকুরবাড়ির পবিত্র মাটিকে অপমান করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন শুভেন্দু। তিনি জানিয়েছেন, এদিন পুরো ঘটনা সবিস্তারে শুনেছেন। ঘটনার দিন মতুয়া সম্প্রদায়ের যে তিন জন আহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ২ জন মহিলাও আছেন। তাঁদের সঙ্গে দেখা করে, তাঁদের শারীরিক পরিস্থিতির খবর নেন শুভেন্দু। মতুয়াদের ভাবাবেগে আঘাত করা হয়েছে বলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
ওই দিন দু’পক্ষের সংঘর্ষের পর বিজেপি নেতা-কর্মী সহ বেশ কয়েকজনকে আটকও করেছিল পুলিশ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরও ঘটনাস্থলে যান, পুলিশ তাঁকেও মারধর করে বলে অভিযোগ ওঠে। মমতাবালা ঠাকুর ও শান্তনু ঠাকুরের অনুগামীদের মধ্যেই সংঘর্ষ হয়েছিল বলে অভিযোগ।