দেশের সময়: ফের স্বমহিমায় শঙ্কর আঢ্য। দীর্ঘদিন ব্রাত্য থাকার পর আবারও জায়গা করে নিলেন তৃণমূলের জেলা কমিটিতে। তাও আবার সাধারণ সম্পাদক পদে। প্রায় দু’বছর পর বনগাঁ পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যানের এই কামব্যাক নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই জোর চর্চা শুরু হয়েছে জেলার রাজনৈতিক মহলে। অনেকেই বলছেন, সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। ফলে শঙ্কর আঢ্যকে তুরুপের তাস হিসেবেই ব্যবহার করতে চাইছে দল। তবে দল নাকি দলের বিশেষ কোনও পদাধিকারী? আসলে এই মুহূর্তে কার বেশি প্রয়োজন শঙ্কর আঢ্যকে? তা নিয়েও জোর চর্চা বনগাঁ জুড়ে।
চায়ের দোকান থেকে পাড়ার মোড়, কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, আসলে পঞ্চায়েতে বাগদার বিধায়ক তথা তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ দাসের ‘অস্ত্র’ শঙ্কর আঢ্য। শঙ্করকে সামনে রেখেই পঞ্চায়েতে বিশেষ করে পঞ্চায়েতে বাগদায় ভালো ফল করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন বিশ্বজিৎ। আর এটা যে তাঁর নিজের পদ বাঁচাতে, এমনটাও মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ। তবে পঞ্চায়েতের আগে এভাবে ‘বড় পদ’ দিয়ে শঙ্কর আঢ্যকে দলে টানা হিতে বিপরীত হবে না তো, এমন প্রশ্নও কিন্তু উঠছে।
কারণ, শঙ্করকে দলের সাংগঠনিক পদ দেওয়া নিয়ে ইতিমধ্যেই তৃণমূলের অন্দরে একটা দ্বন্দ্বের আভাস মিলতে শুরু করেছে। অনেকেই বিষয়টিকে ভালোভাবে নিতে পারছেন না। তাঁদের বক্তব্য, ২০২১ সালে বনগাঁ মহকুমায় তৃণমূলের ভরাডুবির পর কার্যত সাবোতাজের অভিযোগে শঙ্কর আঢ্যর কাছ থেকে সব পদ কেড়ে নিয়েছিল দল। তাঁর বিরুদ্ধে বনগাঁ পুরসভা পরিচালনার কাজেও নানা অভিযোগ উঠেছে। তাহলে যখন পঞ্চায়েতে প্রার্থী করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ইমেজের প্রশ্নে জোর দিচ্ছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন পঞ্চায়েতের আগে শঙ্কর আঢ্যকে দলে সাংগঠনিক পদ দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন জোড়াফুলের সমর্থকদের একাংশ।
গোটা বিষয়টি নিয়ে বনগাঁয় তৃণমূল নেতৃত্ব যে আড়াআড়িভাবে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে, গত কয়েকদিন ধরে তারও ইঙ্গিত মিলতে শুরু করেছে। যদিও এসব নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কোনও মন্তব্য করতে নারাজ।
বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান গোপাল শেঠের কথায়, আমি প্রশাসনিক পদে রয়েছি। ফলে রাজনীতির বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না। দলে কে, কী পদ পেয়েছেন তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। বলারও কিছু নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ মেনে শহরবাসীর জন্য বনগাঁ পুরসভা উন্নয়নের কাজ করে যাবে, এটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য।
গোপাল শেঠ বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলেও তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বিশ্বজিৎ দাস বলেছেন, দল যখন মনে করেছে, শঙ্কর আঢ্যকে দলের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। দলের এখন মনে হয়েছে, তাঁর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো দরকার। ফলে তাঁকে আবার দলে পদ দেওয়া হয়েছে। সবটাই দলের ব্যাপার।
বিশ্বজিৎ দাসের এই কথার সূত্র ধরেই অনেকে প্রশ্ন করছেন, শঙ্কর আঢ্যর কোন অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাইছেন বিশ্বজিৎ? কারণ, বনগাঁর মানুষের অতীত অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো নয়। ব্যবসায়ীরাও একটা সময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন বিভিন্ন কারণে। সেদিনই কি আবার ফেরাতে চাইছেন তৃণমূল নেতৃত্ব? এদিকে, দলে সাংগঠনিক পদ পাওয়ার পর শঙ্কর আঢ্য শুধু বলেছেন, ‘আমি দলের সৈনিক। দল আমাকে যেভাবে কাজে লাগাবে, আমি সেভাবেই কাজ করব।’
গত পঞ্চায়েত ভোটে বাগদার বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূলের একাংশের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাস’ চালানোর অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ওঠে ভোট লুটেরও। এর ফল ভুগতে হয়েছে তৃণমূল নেতৃত্বকে। পঞ্চায়েতে অবাধে ভোট দিতে না পারায় বিধানসভায় সেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। বনগাঁ মহকুমায় ভরাডুবি হয়েছে তৃণমূলের।
রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, বিজেপির টিকিটে বিধানসভায় ভোটে জিতে বিধায়ক হয়েছেন বিশ্বজিৎ দাস। পরে তিনি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। ফলে তাঁকে নিয়ে বাগদায় তৃণমূলের একাংশের মধ্যে এখনও যথেষ্ট ক্ষোভ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও হয়েছে। ফলে এখন যে কোনও উপায়ে পঞ্চায়েত উতরানোই মূল টার্গেট বিশ্বজিতের। না হলে লোকসভা ভোটের আগে পদ খোয়াতে পারেন তিনি। সে কথা মাথায় রেখেই শঙ্কর আঢ্যকে দলে সাংগঠনিক পদে ফেরালেন বিশ্বজিৎ।
শঙ্করকে মূল অস্ত্র করেই তিনি বনগাঁ ও বাগদায় পঞ্চায়েতের ভোট বৈতরণী পার হতে চান। তবে শঙ্করের মধ্যে এমন কী রয়েছে, যে কারণে তাঁর উপর এতটা ভরসা করছেন বিশ্বজিৎ? প্রকাশ্যে এসব নিয়ে মুখ না খুললেও অনেকেই বলছেন, অতীতের দিনগুলোর কথা মনে করলেই সবটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে বিশ্বজিৎ দাস বলেছেন, শঙ্কর আঢ্যর বাড়ি বনগাঁয়। তিনি বাগদায় কী করবেন? আর দল কাকে, কোথায় দায়িত্ব দেবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। আর গত ছ’মাস ধরে আমি পঞ্চায়েতের কাজ করছি। কোথাও কোনও দলীয় কোন্দল নেই।
শঙ্কর আঢ্যকে সাংগঠনিক পদ দেওয়া নিয়ে বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক দেবদাস মণ্ডলের প্রতিক্রিয়া, যে দলটাই আর থাকবে না, যে দলটার নাম চোরের দল, সেই দলে কে এল আর কে গেল, তা নিয়ে বিজেপির কিছু এসে যায় না। তাঁর কথায়, তৃণমূল এটা যেন ভুলে না যায়, গত পঞ্চায়েত ভোট ছিল ২০১৮ সালে। আর এটা ২০২৩ সাল। এখন ৭০ জন বিধায়ক, ১৮ জন সাংসদ। মানুষ ক্ষেপে আছে। তৃণমূল চাইলেও সন্ত্রাস করে ভোট করাতে পারবে না। বিজেপিকে কিছুই করতে হবে না। সাধারণ মানুষই রুখে দেবে তৃণমূলের গুণ্ডা বাহিনীকে। এখন বিজেপির বিকল্প বিজেপিই। একমাত্র বিজেপিই পারে সুশাসন আনতে।
সিপিএমের বনগাঁ শহর এরিয়া কমিটির সদস্য পীযূষ সাহার বক্তব্য, তৃণমূল কাকে পদে ফেরাবে, কাকে বাদ দেবে, গোটাটাই তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে আমাদের কোনও বক্তব্য নেই। আমরা আমাদের বক্তব্য নিয়ে মানুষের কাছে যাচ্ছি। তবে এটুকু বলতে পারি, মানুষ সবটাই নিজেদের উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারছে। হঠাৎ করে মন্দ তৃণমূলকে বাদ দিয়ে ভালো তৃণমূলকে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছিল মানুষের সামনে। কিন্তু এখন মানুষ বুঝতে পারছে, ভালো বলে কিছু নেই, আসলে গোটাটাই মন্দ তৃণমূল।
প্রসঙ্গত, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছিলেন, ১২ এপ্রিলের মধ্যে দলের পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি গঠন করতে হবে। সেইমতো গত বুধবার বিকেলে তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ দাস ও চেয়ারম্যান শ্যামল রায় সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সেখানেই ৩৫ জনের জেলা কমিটি ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি গঠন করা হয় ৬ জনের অ্যাডভাইজারি কমিটি। ওই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে বনগাঁর পুরপ্রধান গোপাল শেঠকে। মূল কমিটিতে পাঁচজনকে সাধারণ সম্পাদক পদে আনা হয়েছে। সেখানেই জায়গা করে নিয়েছেন শঙ্কর আঢ্য।
এরপরই বনগাঁজুড়ে চর্চা শুরু হয়েছে, একসময় বিশ্বজিতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণেই দলে কোণঠাসা হয়ে পড়তে হয়েছিল শঙ্কর আঢ্যকে। কিন্তু সেই বিশ্বজিৎ-ই এখন ফের শঙ্করকে দলের মূলস্রোতে ফেরালেন। আসলে তৃণমূলের অভ্যন্তরের সমীকরণ ঠিক রাখতেই শঙ্করকে ফেরানো হল বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ। তা না হলে কয়েক বছর আগেও যেখানে বিশ্বজিতের সঙ্গে শঙ্কর আঢ্যর রেষারেষি স্পষ্ট ছিল, কীভাবে তা এত মধুর সম্পর্কে পরিণত হল। এখানেই তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, আসলে সময় অনেক কিছুই ঠিক করে দেয়। যতই অম্ল-মধুর সম্পর্ক হোক না কেন, পরিস্থিতি পরস্পরকে কাছাকাছি নিয়ে আসে।
২০১৫ সালে ভোটে জিতে বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান হন শঙ্কর আঢ্য। পরে তাঁকে বনগাঁ শহর তৃণমূলের সভাপতি করা হয়। আরও একাধিক দায়িত্ব পেয়ে কার্যত সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে তোলেন শঙ্কর। তাঁর দাপটে তৃণমূলের বাকিরা কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েন বলে অভিযোগ। যদিও এই ছবি বদলাতে বেশি সময় লাগেনি। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটে দলের ভরাডুবি হতেই সমস্ত সব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় শঙ্কর আঢ্যকে। এমনকী শঙ্কর আঢ্যকে সরিয়ে বনগাঁ পুরসভার প্রশাসক করা হয় গোপাল শেঠকে। গত পুরভোটে শঙ্কর আঢ্যকে টিকিট পর্যন্ত দেয়নি তৃণমূল। যদিও টিকিট পেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী। এদিকে নিজের ক্ষমতা বোঝাতে নিজে আড়ালে থেকে মেয়ে ও দাদাকে কংগ্রেসের টিকিটে দাঁড় করান শঙ্কর। মেয়ে জিতেও যান। তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে শঙ্কর আঢ্য তাঁর মেয়ে ও দাদাকে দাঁড় করানোই অনেকেই ক্ষুব্ধ হন। সেই শঙ্কর আঢ্যের কামব্যাক এখন কতটা ফলপ্রসূ ও মধুর হয় তৃণমূলের জন্য, এখন সেটাই দেখার।