দেশের সময়: মৃত্যুঘণ্টা বেজে গিয়েছে। এবার শুধু মুছে যাওয়ার পালা। হারিয়ে যাওয়ার সন্ধিক্ষণে শতবর্ষের ইতিহাস। পৃথিবীর সেই বিরল সড়কগুলির মধ্যে যশোর রোড একটি, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মুক্তির চেতনা। স্বাধীনতার অহঙ্কার। গোটা জাতির, দু’টি দেশের। নগরায়নের জন্য যশোর রোড সম্প্রসারণ প্রয়োজন। আর তাই এই রাস্তার দু’পাশে থাকা শতায়ু গাছগুলি কাটার পক্ষে রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু শীর্ষ আদালতের নির্দেশ মেনে বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই গাছগুলি কাটার পরিবর্তে নতুন করে গাছ লাগানো হবে তো, এই প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে অনেকের মনেই।
হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে বারাসত থেকে বনগাঁ পর্যন্ত যশোর রোডের দু’পাশের ৩৫৬টি শিরীষ গাছ কাটার ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আর এনিয়ে সীমান্ত শহরে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দেশের শীর্ষ আদালতের রায়কে সম্মান জানিয়ে কেউ বলছেন, গাছ যদি কাটা হয়, তাহলে আদালতের নির্দেশ মেনে যেন নতুন গাছ লাগানোও হয়। বারসত থেকে বনগাঁ পর্যন্ত যশোর রোডের দু’পাশে থাকা গাছের জন্যই জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ থমকে গিয়েছিল। গাছ কাটার বিরোধিতা করে আন্দোলনে নামে একাধিক পরিবেশপ্রেমী সংগঠন। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
এরপর ২০১৮ সালে ৫টি রেল ওভারব্রিজের জন্য হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ৩৫৬টি গাছ কাটার নির্দেশ দেয়। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন পরিবেশপ্রেমীরা। এখন অবশ্য ৩৫৬টি গাছ কাটার প্রয়োজন পড়বে না। কারণ, গত কয়েক বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের জেরে বেশকিছু গাছ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। একটি সমীক্ষা বলছে, এখন ৩০৬টি গাছ কাটতে হবে। এই গাছ কাটা নিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ। তাঁদের বক্তব্য, এই গাছ কাটা না হলে রাস্তা চওড়া করা সম্ভব নয়। আর রাস্তা চওড়া না হলে যশোর রোডে যানজট সমস্যা কখনও মিটবে না।
যদিও বনগাঁর মানবাধিকার কর্মী দেবাশিস রায়চৌধুরির বক্তব্য, উন্নয়নের জন্য গাছ কাটা হবে, ভালো কথা। কিন্তু এই গাছগুলিতে যে পাখিরা এতদিন নিশ্চিন্ত আশ্রয় নিয়ে থাকত, তাদের কী হবে, সেকথা কি আমরা একবারও ভাবছি? এতগুলি গাছ কাটার ফলে বাস্তুতন্ত্রের যে কী সাঙ্ঘাতিক ক্ষতি হবে, তা ভাবার দরকার নেই একবারও? আমরা কি যোশিমঠের ভয়াবহতার কথা মনে রাখব না? এই গাছগুলি কীভাবে এতদিন ভূমিক্ষয় রোধ করেছে, বৃষ্টি এনে দিয়েছে, প্রখর দাবদাহ থেকে এই অঞ্চলের মানুষকে রক্ষা করেছে, সেসব ভাবার দরকার নেই? আমার একটাই আবেদন, যদি গাছ কাটতেই হয়, তাহলে যেন পর্যাপ্ত সংখ্যায় নতুন করে গাছ লাগানো হয়। এবং সেই গাছগুলিকে ঠিকমতো লালনপালন করে বড় করে তোলার দায়িত্ব নেওয়া হয়। এই দায়িত্ব আমাদের সবার।
বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান গোপাল শেঠ বলেছেন, যশোর রোডের সম্প্রসারণ হলে যানজট সমস্যার সমাধান হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্যের যত প্রসার ঘটবে, ততই বনগাঁর অর্থনৈতিক বুনিয়াদ দৃঢ় হবে। তবে এটা ঠিক, বহু ইতিহাসের সাক্ষী যশোর রোডের দু’ধারের এই গাছগুলি। সেগুলি যদি কাটা হয়, তা হলে নতুন করে গাছ লাগাতে হবে। আমরা সবপক্ষকেই একাজে আমাদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান করছি।
বনগাঁর ভূমিপুত্র, কবি বিভাস রায়চৌধুরীর কথায়, সুপ্রিম কোর্টের রায় ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আমারা মেনে নিতে বাধ্য। কিন্তু একটা কথাই বলার, তা হল, আমি বিশ্বাস করি, এই পৃথিবী আসলে গাছেদের। পৃথিবীতে অনেক ধরনের প্রাণী আছে। তার মধ্যে আমরা মানবজাতি অন্যতম একটি প্রাণী। যারা কার্যত জবরদখল করে নিজেদের স্বার্থে প্রকৃতিকে নিধন করে চলেছি। করোনার সময় আমরা দেখেছি, অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছোটাছুটি করছেন মানুষজন। অথচ করোনা যেই একটু থিতু হয়েছে, অমনি আবার সেসব ভুলে গিয়ে প্রকৃতি নিধনে মেতে উঠেছি। মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে কিছু প্রাণীকে তো হত্যা করতেই হয়। সেকারণে আমাদের উচিত, কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকৃতিকে দেখার। কিন্তু তা না করে আমরা লোভির দৃষ্টিতে প্রকৃতিকে দেখছি। এর পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। শতবর্ষ প্রাচীন গাছ কেটে তার পরিবর্তে কয়েকটা চারাগাছ লাগানো, এটাকে ব্যক্তিগতভাবে হাস্যকর ক্ষতিপূরণের প্রয়াস বলেই মনে করি।
ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়েতের প্রধান প্রসেনজিৎ ঘোষ বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়কে সাধুবাদ জানাই। আমরা চাই, রাস্তা চওড়া হোক। অপ্রশস্ত রাস্তার কারণে প্রতিনিয়ত যশোর রোডে যে দুর্ঘটনা ঘটছে, তা বন্ধ হোক। যশোর রোড ঘিরে পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে বাণিজ্য আরও প্রসার লাভ করুক। তবে একটি গাছ কাটার পরিবর্তে পাঁচটি চারাগাছ লাগিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ব্যাপারে আমরাও সাধ্যমতো উদ্যোগ নেব।
যশোর থেকে শ্যামবাজার দীর্ঘপথে রাস্তার দু’পাশে সার দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে থাকা গাছগুলির সঙ্গে ঠিক কীভাবে জড়িয়ে রয়েছে দু’বাংলার মানুষের আবেগ, তা জানতে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে অনেকগুলো বছর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যশোর রোড ধরে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষ পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। অ্যালেন গিনসবার্গের বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ আজও জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে প্রায় ১২২ কিমি দীর্ঘ এই রাস্তা। এপারে পেট্রাপোল, ওপারে বেনাপোল। মাঝে নো ম্যানস ল্যান্ড। দু’দেশের সীমারেখা। কাঁটাতার। কিন্তু তারই মাঝে যেন যশোর রোড দুই বাংলার মধ্যে গড়ে তুলেছে পরম আত্মীয়তা। আর এই সেতুবন্ধনের সাক্ষী থেকেছে যশোর রোড।
এই রাস্তাকে ঘিরে রয়েছে কত জানা, অজানা কাহিনী। জীবন্ত ইতিহাস। এই রাস্তা দিয়েই সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। যা এই রাস্তার গৌরবকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। সম্রাট শের শাহ ১৫৪০-৪৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সোনারগাঁ থেকে এখনকার পাকিস্তান পর্যন্ত গড়ে তুলেছিলেন গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। যশোর, বেনাপোল, বনগাঁ, কলকাতা ছুঁয়ে সেই রাস্তা চলে গিয়েছে লাহোর, পেশোয়ার পর্যন্ত। কিন্তু ইংরেজদের বাংলা দখলের আগে সংস্কারের অভাবে কার্যত মেঠো পথে পরিণত হয় সেই রাস্তা। তখন দস্যু, লস্করের হামলার ভয়ে ঝুঁকি নিয়ে এই পথ দিয়ে যাতায়াত করতেন রাজকর্মচারি ও ব্যবসায়ীরা। সেসময় যশোর থেকে কলকাতায় আসার বিকল্প পথ বলতে জলপথ।
কিন্তু জেলা হওয়ার পর গুরুত্ব বেড়ে যায় যশোরের। প্রসার ঘটে ব্যবসা, বাণিজ্যের। যশোরে তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ ভালোই বাস। তাঁদের কাছে গঙ্গাস্নান অত্যন্ত পবিত্র ও পুণ্যের। তাঁরা গঙ্গাস্নানের জন্য নদীপথে কলকাতায় আসতেন। কেউ কেউ আবার আসতেন পালকি যোগে। কিন্তু খারাপ রাস্তার কারণে তাঁদের দুর্ভোগের অন্ত থাকত না। অনেকে আবার বনগাঁ হয়ে গঙ্গাস্নানের জন্য চলে যেতেন চাকদহে। সেসময় যশোরের বকচরের জমিদার ছিলেন কালীপ্রসাদ পোদ্দার। কলকাতায় তাঁর বাণিজ্য ছিল। নৌকার মাঝিদের অসহযোগিতার জন্য একবার তাঁর মা গঙ্গাস্নানে যেতে পারেননি। এতে অপমানিত হয়ে তিনি ঘরে দরজায় খিল এঁটে অনশনে বসেন। উদ্বিগ্ন পুত্র মাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু লাভ হয় না। অবশেষে মা তাঁকে নির্দেশ দেন, যশোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত তিনি যদি রাস্তা তৈরি করে দিতে পারেন, তবেই অনশন ভঙ্গ করবেন তিনি। মায়ের নির্দেশ মতো বকচরের জমিদার রাস্তা তৈরি করেন, সেটিই আজকের যশোর রোড। মায়ের গঙ্গাস্নানে আসার পথে যাতে রোদে কষ্ট না হয়, সেজন্য রাস্তার দু’ধারে গাছ লাগিয়েছিলেন তিনি। অতীতে যশোর রোডকে অনেকে কালীবাবুর রাস্তা বলে অভিহিত করতেন।