‘ট্রাভেলগ’ (পর্ব-৮)
লিখছেন~ দেবন্বীতা চক্রবর্তী,
“না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে
দিবশেষে ধন হারায়েছি ,আমি পেয়েছি আঁধার রাতে”
রবিঠাকুরের এই গানটা হঠাৎ মনে পড়ল , তিনি কি করে যে মানুষের মনের গভীরে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন অবস্থার জন্য মানানসই রকমারি গান সৃষ্টি করলেন তা কে জানে! আমাদের বর্তমান অবস্থা এই গানটার ব্যখ্যাতেই বোঝানো যাবে ৷ একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে , মনিকরণ যাওয়ার পথে যে চায়ের দোকানে আমরা চা খেতে নেমেছিলাম সেখানেই ঠিক হয় যে এবার আমরা আর কুলুর দিকে যাব না ৷
কুলু ঘোরার আশা সবার মিটে গিয়ে নতুন সখ হল সোজা প্রতিবেশী রাজ্য পঞ্চ নদের দেশ পঞ্জাব যাব ৷ ভাবা যায়? মানুষের বদ খেয়াল বলে কথা ….কোথায় মনিকরণ আর কোথায় পঞ্জাব অমৃতসর? শুভঙ্কর বাবুর কিন্তু আমাদের প্রস্তাবে সাই নেই ,তার যথেষ্ট কারন ও আছে । প্রথমত মনিকরণে পৌঁছাতেই আমাদের বাজবে রাত ৮ টা মতো , সেই অনুযায়ী আশেপাশে কোথাও রাত কাটিয়ে যদি পরের দিন ও আমরা পঞ্জাবের উদ্দেশ্যে রওনা দিই তাহলেও অমৃতসর পৌঁছাতে লাগবে বিকাল ৷
তার পরের দিন ই ফেরার ট্রেন ৷ স্বভাবতই কিছুই দেখা হবে না ৷অর্থাৎ প্ল্যান ক্যানসেল ৷বেজার মুখ নিয়ে আমরা সবাই নামলাম মনিকরণ ৷কিন্তু সেখানে গিয়ে পড়তেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল ৷ কুলু থেকে ৪৪ কিমি আগে পার্বতী ও বিয়াস নদীর সঙ্গোমস্থলে মনিকরণ প্রসিদ্ধ স্থান ৷ রাত হলেও বুঝলাম জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব , চারিদিকে ধাপে ধাপে পাহাড়ের গায়ে আলো দিয়ে যেন দীপাবলির প্রদীপ সাজিয়েছে কেউ ৷
সামনে খরস্রোতা পার্বতী ও বিয়াসের সঙ্গোমস্থলের উপর সেতু ,আর সেতুর ওপারে বিশ্বের ঊষ্ণতম প্রস্রোবন মনিকরণ তীর্থ । কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় আমাদের মাথার উড়নি উড়ে চলে যেতে চাইছে , আবার এক প্রাগৈতিহাসিক পথে আগমন , নতুনের জন্যে পুরাণের উদ্ঘাটন ৷ মনিকরন সাক্ষাৎ ব্রহ্মার স্বরূপ , দেবদেবীরা স্নান করতে আসতেন এখানে ,সেই থেকে সূত্রপাত নতুন কাহিনীর । গুরুদ্বারায় দাঁড়িয়ে সেই গল্প শুনলাম মায়ের মুখে ৷
মা এত কিছু জানে কোত্থেকে?…. আমাদের তো বার বার হাত চলে যায় গুগলে । মা শোনালেন….একদা শিব ও মা পার্বতী একত্রে স্নানরত অবস্থায় পার্বতীর কানের দুলের আলগা মনি টি ওই নদীর জলে পড়ে আর সোজা পাতালে চলে যায় ও শেষনাগ সেটিকে পেয়ে নিজের কাছে রেখে দেয় ৷ এদিকে মনিটি পার্বতীর প্রিয় হওয়ায় সেটি ফেরৎ না পেয়ে মাতা পার্বতী মুখ গোমড়া করে থাকেন ।
তখন প্রিয় পত্নীর মনিবিরহ সহ্য করতে না পেরে শিব বসেন ঘোর তপস্যায় ,যার ফলে শেষনাগ মাটি ফুরে উঠে আসেন মনি সমেত , কিন্তু পাতালের উষ্ণ জল ও মাটিও উপরে আসে সাথে সাথে । শেষনাগ পার্বতীর মনিটির সাথে নকল আরও অনেক মনি মিশিয়ে শিবকে দান করেন ,ভোলানাথ তো নির্লোভ , তিনিও আসলটি রেখে নকল গুলিকে পাথর বানিয়ে প্রস্রোবন চাপা দিয়ে দেন …এই হল মনিকরণ ৷
এর পর চলে আসছে সোজা ১৫৭৪ সালে …যখন গুরু নানক এসে নতুন করে আবিষ্কার করেন এই প্রস্রোবন ও তৈরী হয় গুরুদ্বারা যেখানে সর্বদা গ্রন্থসাহেব পাঠ ও লঙ্গর চলছে । পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা স্নানঘর ও রয়েছে ,কারন এই সালফার যুক্ত প্রস্রোবনের জল শরীরের রোগব্যাধী দূর করে ৷
ঘুরতে ঘুরতে আমরা দেখলাম ছোট ছোট জানালা মতো ঘুপচি রাস্তা দিয়ে স্থায়ী শিখরা কোথায় যেন ঢুকে পড়ছে নেংটি ইদুরের মতে…… কৌতুহল দমন করতে না পেরে গিয়ে দেখি….ওমা এতো পাথর দিয়ে ঘেরা স্টিম রুম! কিছুক্ষন বসতেই গায়ের ক্লান্তি , ব্যাথা সব উধাও ৷আর সেখানে লোকে দিব্যি শুয়ে ঘুমাতেও পারে….বোঝো কান্ড!!! কিন্তু এই আরাম বেশিক্ষনের জন্য নয় ৷ আমাদের হাতে সময় নেই একদম……