দেশের সময়,পেট্রাপোল: আগামী সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রপ্তানী বানিজ্য বন্ধ থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বৃহস্পতিবার এই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছেন পেট্রাপোলসীমান্তে পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা।
পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে রপ্তানী বানিজ্যের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলির যৌথ আন্দোলনে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পেট্রাপোল স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হটকারী সিদ্ধান্তের অভিযোগ তুলে ফের বৃহস্পতিবারও আন্দোলন সংগঠিত হয় এই সীমান্তে।
এই ঘটনা ঘটলে আদান–প্রদান বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে। এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে। কারণ এখান থেকে ট্রাকে করে বহু সামগ্রী বাংলাদেশে আসে। সেটা বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে।
কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে? এদিন পেট্রাপোল সেন্ট্রাল পার্কিংয়ের সামনে বিক্ষোভ দেখান পরিবহণ কর্মীরা। তাঁদের অভিযোগ, নতুন এলপি ম্যানেজারের কারণে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। হঠাৎ করে নতুন আইন এনে কাজে সমস্যা সৃষ্টি করছেন। করোনাভাইরাস আবহে আয় কমে গিয়েছে। তার উপর বিএসএফ–কে কাজে লাগিয়ে আটকানো হচ্ছে। তাই এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাওয়া পন্য বোঝাই ট্রাক পেট্রাপোল স্থল বন্দরে প্রবেশ করার পর নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে সেই ট্রাক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এই কাজের জন্য এতোদিন পরিবহন সংস্থার কর্মীরা সেই স্থান পর্যন্ত প্রবেশ করতেন। সম্প্রতি দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে পরিবহন কর্মীদের সেখানে যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
পেট্রাপোল সীমান্তে পরিবহণ কমীরা কাজ বন্ধ করে দিলে কতটা ক্ষতি হবে? জানা গিয়েছে, আদান–প্রদান বাণিজ্যের এটা একটা বড় মাধ্যম। এখানের জিনিসপত্র যেমন বাংলাদেশে যায়, তেমনই বাংলাদেশের জিনিসও পশ্চিমবঙ্গে ঢোকে। বাংলাদেশ থেকে এখানে জিনিসপত্র কম ঢোকে। তবে বেশি সামগ্রী এখান থেকেই যায়। ফলে ওপার বাংলায় জিনিসের দাম বেড়ে যেতে পারে। এপারেও প্রভাব পড়তে পারে।
কতদিন এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে? পরিবহণ কর্মীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রোজই বিক্ষোভ দেখানো হবে। করা হবে আন্দোলনও। তবে দাবি মানা না হলে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের পথে যাবেন তাঁরা।
এই ঘটনার প্রতিবাদে গত কয়েকদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন পরিবহন সংস্থারগুলি। এব্যাপারে বনগাঁ গুডস ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খোকন পালের অভিযোগ, ‘পেট্রাপোল স্থল বন্দরের বর্তমান ম্যানেজার কমলেশ সাহানী পরিবহন সংগঠনগুলির সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা ছাড়াই নতুন নতুন নিয়ম চালু করছেন। এর ফলে রপ্তানী বানিজ্যে ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের দাবি না মানা হলে সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই সীমান্ত দিয়ে বানিজ্য বন্ধ রাখা হবে।’
প্রসঙ্গত, পণ্য খালাসের জন্য শ্রমিকদের পরিচয়পত্র দেওয়া ঘিরে বিতর্ক। তার জেরে দিনের পরদিন পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে পণ্যের আমদানি রফতানি ব্যাহত হওয়ার গোটা ঘটনায় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছে রফতানিকারক সংস্থা এবং পণ্য খালাসকারী সংস্থার সংগঠনগুলি।
একই অভিযোগ করছেন পণ্য খালাসকারী এজেন্টদের সংগঠনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘পণ্য খালাস এবং বোঝাই করা যাঁদের দায়িত্ব তাঁদের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার ফলে আমদানি-রফতানির কাজ ব্যাহত হচ্ছে । এর জন্য সরকারি আধিকারিকদের অযোগ্যতাই দায়ী।’’
পেট্রাপোল এক্সপোর্ট এন্ড ইমপোর্ট এ্যাসোসিয়েশন-এর সম্পাদক প্রদীপ দে বলেন আগামীদিন অর্থাৎ শনিবার তাঁদের সংগঠনের পক্ষ থেকেও অ্ন্যান্য সংগঠনের পক্ষে আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন এবং পাশাপাশি পেট্রাপোল সীমান্ত বন্দরের আমদানি-রফতানির কাজ চালু রেখে কী ভাবে তাদের এই সমস্ত আন্দলোন জারি রেখে প্রতিটি সংগঠন এবং শ্রমিকদের দাবি গুলি যাতে মান্যতা পায় তার প্রচেষ্টা করা হবে একত্রিত ভাবে৷
স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে আইসিপি-পেট্রাপোলে একাধিক চোরাচালানের ঘটনা ঘটেছে সেই সব নজরে আসতেই , বিএসএফ তাঁদের নজরদারি এবং সতর্কতা ব্যবস্থা আরও কড়াকড়ি করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে।
বিএসএফ সাফ জানিয়েছে, জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালককে কোনও ভাবেই বাংলাদেশে যেতে দেওয়া যাবে না কারণ এই ধরনের চালকরা জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের ভিত্তিতে শুল্ক বিভাগ থেকে গাড়ির পাস নেয়, যার ভিত্তিতে বিএসএফ ট্রাকগুলিকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য, বিএসএফ বনগাঁ ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনকে একটি স্থায়ী অপারেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলেছে যাতে দেশের নিরাপত্তা এবং স্বার্থের সঙ্গে আপস করা না হয়।
যে কারণে বিএসএফ আইসিপিতে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে
বিএসএফ আইসিপি-পেট্রাপোলের সমস্ত বেআইনি কার্যকলাপ ঠেকাতে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে। সম্প্রতি, ০৪ জানুয়ারী, ২০২২-এ, বিএসএফ একজন পরিবহণকারীর কাছ থেকে ১,৪৪,২২,৩৫৬/- টাকা মূল্যের সোনা উদ্ধার করেছিল, যখন আইসিপি পেট্রাপোলে পাচার নিরাপত্তা কর্ডন থেকে একটি বাইকে সেগুলি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। পরে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা একটি ট্রাকের ভিতরে লুকিয়ে রেখে এই সোনা বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়। একই রকম ভাবে ১৯ জুলাই, ২০২১-এ, যখন বাংলাদেশ থেকে আগত ভারতীয় ড্রাইভারের কাছ থেকে বিএসএফ কর্তৃক ১,৭১,৮০,৪২০/- টাকার সোনা উদ্ধার করে।
আরও একটি ঘটনায়, ২১শে আগস্ট ২০২১-এ, রপ্তানি পণ্য আনলোড করার পরে বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসা একটি খালি ভারতীয় ট্রাক থেকে ১,৬৮,৩৮,৫০০/- মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা (সৌদি রিয়াল উদ্ধার করা হয়েছিল।
বিশেষ সূত্রের খবর,বিএসএফ কর্মীরা ০৯ জানুয়ারী, ২০২২-এ এই আই সি পি-তে একটি ভারতীয় ট্রাক থেকে ৫০ কেজি গাঁজা বাজেয়াপ্ত করেছিল। এছাড়াও, নিয়মিতভাবে, আইসিপি পেট্রাপোলে নিযুক্ত বিএসএফ মাদকদ্রব্য সহ বেশ কয়েকটি অবৈধ জিনিস আটক করা করে।
ভারতীয় পরিবহণকারী, শ্রমিক, চালক, হেলপার এবং বিভিন্ন এজেন্ট/সহকারী এজেন্টরা এই সমস্ত অবৈধ কার্যকলাপে ভূমিকা পালন করে বলে অভিযোগ ৷
উল্লেখ্য, অনেক সময় ভুয়ো ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালকরা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। এমনকি ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে একজন ট্রাক চালকের হাতে পিষ্ট হয়ে বিএসএফ এর এক জওয়ানের প্রাণ হারিয়েছে। অতএব, এটিও প্রয়োজন যে বিএসএফ ড্রাইভিং লাইসেন্সের বৈধতা পরীক্ষা করতে পারে।
স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, এত দিন ধরে নির্দিষ্ট সংস্থার পরিচয়পত্র নিয়ে পার্কিংয়ের ভিতরে যাতায়াত করতেন শ্রমিকরা। কিন্তু এ বার তাঁদের সকলের জন্য এক পরিচয়পত্র করার কথা বলছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত সেই পরিচয়পত্র না হচ্ছে তত দিন পর্যন্ত বর্তমান পরিচয়পত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার দাবি করেছে আমদানিকারী সংস্থাগুলি। যদিও বন্দর কর্তৃপক্ষ তা মানতে নারাজ বলে অভিযোগ। এই প্রতিবেদন লেখার মুহুর্ত পর্যন্ত পেট্রাপোল সীমান্তে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন পরিবহন সংস্থারগুলি ৷