দেশের সময় ওয়েবডেস্ক: মোবাইলের প্রতি আসক্তি ছিল। তা বাড়ছিলও। কিন্তু প্রায় দু’বছর পরিস্থিতি টা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রয়োজন না থাকলে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না কেউই। খেলতে বেরোতে পারছে না শিশুরাও। স্কুলও বন্ধ। এই অবস্থাতেই তারা মোবাইলের প্রতি এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, যে তার কুপ্রভাব পড়ছে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর। সম্প্রতি দেশজোড়া একটি পরিসংখ্যানেও ধরা পড়েছে সেই উদ্বেগের ছবি।
ভাইরাস বিদায় নিলেও অতিমারির প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। বড়দের পাশাপাশি শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকরা। প্রায় দু’ বছরের সময় ধরে ঘরবন্দি জীবনযাপন মারাত্মক ক্ষতি করছে শিশুদের।
কয়েক মাস আগে রাজস্থানের জয়পুরের একটি হাসপাতাল দেশজুড়ে শিশুদের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাতে যে সব তথ্য উঠে এসেছে তা ভয়ঙ্কর। ওই সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ক’মাসের পরিস্থিতির জেরে ৬৫ শতাংশ শিশু স্মার্টফোনের উপরে অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তারা আধঘণ্টার বেশি স্মার্টফোন ছেড়ে থাকতেই পারছে না। এই স্মার্টফোন আসক্তির প্রভাব পড়ছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেও। সমীক্ষায় প্রকাশ, ফোন ছাড়তে বলা হলে শিশুরা রেগে যাচ্ছে, কাঁদতে শুরু করছে, চেঁচিয়ে রাগ-বিরক্তি প্রকাশ করছে।
রাজস্থানের বিভিন্ন শহর ছাড়াও দেশের নানা বড় শহর, যেমন কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, আগ্রা, লখনউ, চণ্ডীগড়ে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। তাই অনুমান করা যেতে পারে, দেশজুড়েই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। যে সব শিশুর মধ্যে সমীক্ষা করা হয়েছে তাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশেরও বেশির ভাগ শারীরিক সমস্যায় ভুগছে, যার কারণ আসলে অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তিই। সমীক্ষায় প্রকাশ, ২৩.৪ শতাংশের ওজন বেড়ে গিয়েছে, ২৬.৯ শতাংশ মাথাব্যথা বা বিরক্তিতে ভুগছে, ২২.৪ শতাংশের চোখ জ্বালার মতো সমস্যা হচ্ছে।
মোবাইলে আসক্ত শিশুদের মধ্যেও যাদের মোবাইলের নেশা অত্যান্ত বেশি তারা আরও কঠিন সমস্যার শিকার। অতিরিক্ত আসক্তদের বেশিরভাগই আচার-আচরণগত সমস্যা প্রকাশ পাচ্ছে। ২৩.৯ শতাংশ তাদের নিয়মিত রুটিন এড়িয়ে যাচ্ছে, ২০.৯ শতাংশ একেবারে দায়সারা হয়ে পড়ছে, ৩৬.৮ শতাংশ একগুঁয়ে হয়ে পড়ছে এবং ১৭.৪ শতাংশ শিশু কোনও জিনিসেই বেশিক্ষণ মন দিতে পারছে না।
বিশেষত শিশুদের চোখে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, সংক্রমণের ভয়ে বাইরে খেলতে যেতে দিচ্ছেন না অভিভাবকরা। ফলে বাড়িতেই টিভি দেখার অভ্যাস, মোবাইল, কম্পিউটারে গেম খেলে সময় কাটাচ্ছে শিশুরা। চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে মানসিক চাপ পড়ছে একদিকে। আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল, ল্যাপটপ, টেলিভিশনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকে চোখের নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
চোখ থেকে জল পড়া, চোখ জ্বালা করা, চোখ শুকিয়ে আসা, মাথা যন্ত্রণা করা, এমন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে অধিকাংশ শিশুর শরীরে। বিশেষজ্ঞরা আরও জানাচ্ছেন, আগেও ছোট বয়সে শিশুদের চোখে মাইনাস পাওয়ার চলে আসত। কিন্তু এমন শিশুর সংখ্যা অতিমারির পর থেকে একলাফে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগে শিশুদের চোখে কোনও সমস্যা হলেই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতেন অভিভাবকরা।
কিন্তু বর্তমানে সমস্যা অনেকটা ছড়িয়ে পড়ার পর চক্ষু বিশেষজ্ঞদের কাছে শিশুদের নিয়ে আসা হচ্ছে। অনলাইন ক্লাস থেকে স্মার্ট ফোনে গেম খেলা, এই সবকিছুর জন্য চোখের সিলিয়ারি মাসল দুর্বল হয়ে যায়। তাই বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, ক্লাসের মাঝে চোখকে বিশ্রাম দেওয়া জরুরি। ক্লাসের শেষে খানিকক্ষণ বিরতি নেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়াও দিনে অন্তত দুই ঘণ্টা বাইরে কাটাতে দিতে হবে শিশুদের। এর ফলে মাইনাস পাওয়ার বৃদ্ধির আশঙ্কাও কমবে।
যে সব শিশুদের মধ্যে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল তাদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ ছিল ছেলে ও ৪৫ শতাংশ মেয়ে। সমীক্ষায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ট্যাবলেটের মতো নানা জিনিস ব্যবহার করলেও মোবাইলই সর্বাধিক ব্যবহার করছে শিশুরা। এমনিতেই অনলাইনে ক্লাসের জন্য শিশুদের অন্তত ১ ঘণ্টা থেকে ৮ ঘণ্টা দিতে হয়। তার উপর লকডাউনে ঘরবন্দি থাকার জেরে সব শিশুর ‘স্ক্রিন টাইম’ (যতক্ষণ সে কোনও যান্ত্রিক পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকে) বেড়ে গিয়েছে দুই থেকে তিন গুণ।
মোবাইলের প্রতি এই আসক্তির ফলে সমস্যা হচ্ছে ঘুমেরও। অর্ধেকের বেশি শিশুর শুয়ে পড়ার পরে ২০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা অবধি ঘুম আসছে না। ১৭ শতাংশ শিশু ঘুমের মাঝে ঘুম ভেঙে উঠে পড়ছে। সহজে আর ঘুম আসছে না। দিনে ঘুম পাওয়া, ক্লান্তি, বিরক্তি, মাথা ও গায়ে ব্যথার মতো সমস্যাতেও ভুগছে শিশুরা।
দেশ-বিদেশের একাধিক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, মোবাইলের নেশা অন্য নেশার দ্রব্যের নেশার মতোই ভয়ঙ্কর হতে পারে। কারণ, অন্য নেশার মতোই মোবাইলের নেশাও মানুষের অনুভূতির উপর প্রভাব ফেলছে। অন্য নেশা ছাড়া যেমন কঠিন, তেমনই কঠিন হতে পারে এই নেশা েথকে বেরিয়ে আসা। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন ধীরে ধীরে এই সমস্যা থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায় সেই চেষ্টা করা উচিত শিশুর অভিভাবকদের।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এই সমস্যাগুলির বিষয়ে শিশুর অভিভাবকদের অত্যন্ত সতর্ক হওয়া দরকার। টানা এমন সমস্যা চলতে থাকলে তা দীর্ঘমেয়াদী জটিল অসুখের কারণ হতে পারে। মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ার পরে কেবল যে তাদের মনের সমস্যা হচ্ছে তা নয়, প্রভাব পড়ছে তাদের স্বাস্থ্যেও। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলদ্ধি না করলে পরিণাম আরও গুরুতর হবে, সতর্ক করছেন চিকিৎসকেরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে সব শিশু মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে তাদের একেবারে মোবাইল ছুঁতে না দিলে তারা বিরক্ত হবে। একটু একটু করে কমাতে হবে। যে কাজে তারা আনন্দ পায়, সেসবের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে মোবাইল ব্যবহার কমাতে হবে অভিভাবকদেরও। তবে শিশুরাও তা শিখবে।