পথেই হবে এ পথ চেনা……।।
অশোক মজুমদার
সব পথ এসে মিলে গেল শেষে’র ঢঙেই গ্রামের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আঁচ শহরেও এসে পৌঁছেছে। শঙ্খ ঘোষ, ও অনুব্রতকে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে দিয়ে অশালীন তরজায় ইন্ধন দিচ্ছেন বুদ্ধিজীবী বলে বিজ্ঞাপিত একদল মানুষ। আমার মনে হয় এ দুজন কেউই কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, হওয়ার কোন প্রশ্নও আসে না। কিছু মন্তব্য ও কবিতার উদ্ধৃতিকে ব্যবহার করে এই বিতর্কটা বস্তুত তৈরি করা হল। কর্মসূত্রে আমার বেশ কয়েকবার শঙ্খ বাবুর কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। মৃদুভাষী ও সজ্জন এই মানুষটি বাংলা ভাষা তো বটেই, এই সময়ের ভারতীয় সাহিত্যেরও এক প্রধান কবি। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন তিনি। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ঘটনার প্রতিবাদে তিনি রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁর কবিতা আমাদের উদীপ্ত করেছিল। আবার সাম্প্রতিক সময়েও তিনি সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে প্রতিবাদী মিছিলে হেঁটেছেন। তাঁর বক্তব্যের সবসময় একটা আলাদা গুরুত্ব থাকে। মানুষটা শঙ্খ বাবু বলেই আমার বিনয়ী জিজ্ঞাসা, দুটো ঘটনা আর সময় কি এক? রাজ্যের এখনকার পরিস্থিতি কি সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাইএর ঘটনার সময়কালের মত? অনুব্রতকে কটাক্ষ করার মধ্যে দিয়ে রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে তাঁর বক্তব্যে আমি কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত এবং অনেকটাই হতাশ।
এই বয়সে শঙ্খ বাবুর বাংলার গ্রামে ঘোরাঘুরি করার সুযোগ আগের তুলনায় অনেক কম। এই শহরেই থাকেন তিনি। গ্রামের কথা থাক, বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় নামার পর তাঁর যা অভিজ্ঞতা, তাতে কি এই শহরটাকে বদলে যেতে দেখছেন না তিনি? পথঘাট, আলো, বর্জ্য সাফাই, নিকাশি ব্যবস্থা, যান নিয়ন্ত্রণ সব ব্যাপারে শহর যে বদলে গেছে তাতো পথে নামলেই বোঝা যায়। আপনি যেখানে থাকেন সেই হাডকো মোড় সংলগ্ন এলাকাটি আগে ভারি বর্ষায় জলে ডুবে যেত। এখন সে ছবি বদলে গেছে। আপনার বাড়িতে আসা তরুণ কবিদের নিয়ে গাড়িতে চারপাশের কয়েক কিলোমিটার ঘুরে এলে উন্নয়নের এই ছবিটা ‘পথেই হবে এ পথ চেনা’ গানটার মতই স্পষ্ট হবে। এমনকি দিদির কট্টর বিরোধীরাও এ নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলতে পারছেন না। সত্যিই তো উন্নয়ন পথেই দাঁড়িয়ে আছে।
অনুব্রত ভুল বললেন কোথায়? চৌত্রিশ বছর শাসন করার পরও শহরের নর্দমাগুলিকে ঢাকার মত জরুরি কাজটা যারা করতে পারেন নি, তাদের সমালোচনাকে আমি গুরুত্ব দিই না। কিন্তু আপনাকে গুরুত্ব দিই। তাই আপনি যখন অনুব্রতর রাস্তায় উন্নয়ন দাড়িয়ে আছে কথাটাকে কটাক্ষ করেন, সেই মন্তব্যটাকে নিয়েই রচনা করেন কবিতা, তখন একই সঙ্গে অবাক ও আহত হই। রাজ্যের কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, জল ধরো, জল ভরো-র মত প্রকল্পগুলির সাফল্য না দেখে আপনার মত একজন কবির মনশ্চক্ষে শুধু একটা খড়্গর ছবি ভেসে উঠল।
অনুব্রতর পাশাপাশি আপনার ছবি ছাপা হচ্ছে আজকাল! এ জিনিসও দেখতে হল! যারা এই কাজটি করলেন তারা আপনার প্রকৃত বন্ধু কি না তার বিচার সময়ই করবে। অনুব্রত বীরভূম জেলার স্থানীয় স্তরের এক নেতা। আর আপনি ভারতের এক অগ্রণী কবি। দুজনের মেধা, মনন, দৃষ্টিভঙ্গি ও উপস্থাপনার মধ্যে কোন তুলনাই চলে না! অনুব্রত তার নিজের মত করে উন্নয়ন নিয়ে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে। তার বলার মধ্যে একটা গ্রাম্য কর্কশতা রয়েছে, কিন্তু তার বক্তব্যের মূল কথাটাকে বাদ দিয়ে বলার ভঙ্গীটাকে নিয়েই হাওয়া গরম করতে চাইছে বাজারি কাগজ। আর আপনার মত স্থিরবুদ্ধি মানুষ সেই খেলারই এক অংশীদার হয়ে গেলেন! এ কোন কবি, একে চিনি না জাতীয় যেসব কথা অনুব্রত বলেছেন সেটাও ঠিক নয়। সব কবিকেই যে তিনি চিনবেন তা নাও হতে পারে আবার তিনি চেনেন না বলেই তারা কবি নন সে কথাও ভুল। না জেনে মন্তব্য করে অনুব্রত ভুলই করেছেন। না চেনা, না জানা মোটেই বুক বাজিয়ে বলার মত কোন ব্যাপার নয়। উপস্থাপনার ভুলেই তিনি কেস খেলেন।
আমাদের তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর সবাইকে কি আমরা চিনি? আর আমরা চিনিনা বলেই কি তারা দেবতা নন? একেকজন দেবদেবীর পুজো তাদের ভক্তরা করেন। আমার বাবাও রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বাইরে আর কোন কবিকে চিনতেন না। কিন্তু একটা রেল ইঞ্জিনের খুঁটিনাটি ছিল তাঁর মুখস্ত। এখনও সারা পশ্চিমবঙ্গে এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। আমরা প্রত্যেকেই যে জিনিসটা নিয়ে কাজ করি সেটাকেই বেশি করে চিনি। শঙ্খ বাবুকে না চেনার অপরাধে অনুব্রতকে যারা কাঠগড়ায় তুলেছেন তারাও একই ভুল করছেন। এই না চেনা মানুষগুলোকে কোনভাবেই অপরাধীর তালিকায় ফেলা যায় না। অসংখ্য কবি অধ্যুষিত এই দেশে পাঠ্য পুস্তকের বাইরে থাকা কিংবা সেখানে কম থাকা কবিদের আমরা অনেকেই চিনি না।
আসলে গ্রামের লোকেদের প্রতি আমাদের শহুরে বুদ্ধিজীবীদের একটা অবজ্ঞা রয়েছে। অনুব্রত রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ছাড়া আর কোন কবিকে চেনেন না বলতেই শিল্প সংস্কৃতির ঠিকাদাররা গেল গেল রব তুলেছেন। আমার মনে পড়ছে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখন আমি আনন্দবাজারে। সরকার বাড়ির তৎকালীন কর্ণধার বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ খুব একটা বড় কবি নন। একথাটা সেসময় অফিসে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমাদের মত সামান্য লোকজন হাসাহাসি করেছিল কিন্তু কোন প্রতিবাদ হয়নি। কারণ, প্রতিবাদ করলেই সরকারদের খাতা থেকে নাম কাটা যাবে। অনুব্রত গ্রামের লোক বলেই তাকে পেড়ে ফেলা গেছে।
শঙ্খ,অনুব্রত বিতর্কে রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনে একটা সাংস্কৃতিক রঙ লাগলো। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি খড়্গ হাতে উন্নয়ন কথাটা বলে শঙ্খ বাবু রাজনীতিই করেছেন। বাড়িতে বসে নয়, পথে নেমেই চিনতে হবে উন্নয়নকে।