পার্থ সারথি নন্দী: মাটির কাজে রোদের প্ৰয়োজন। মাকে যে মণ্ডপে পাঠাতে হবে যে। বৃষ্টির বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে পটুয়া পাড়ার শিল্পীদের। ঘুম উড়েছে একেবারে।
টানা বৃষ্টিতে চাল ফুঁড়ে জল নেমেছে, বেশ কিছু ঠাকুরের মূর্তি ধুয়ে গেছে কোথাও কোথাও। মাথার ওপর ছাতা ও প্লাস্টিক ঢেকে কোনও রকমে বড় বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। সামান্য যেসব মাটি ধুয়ে গেছে সেইসব জায়গায় প্রলেপ লাগানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন শিল্পীরা।
আকাশ কালো করে হঠাৎই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির তোড়ে দিশেহারা অবস্থা কুমোরটুলির শিল্পীদের। বুঝে ওঠার আগেই মায়ের মাটির মূর্তির ওপর বৃষ্টির জল পড়ছে। প্লাস্টিক চাপা দেওয়ার আগেই যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। গলে গেছে মূর্তির কিছু কিছু অংশ। গলে যাওয়া জায়গায় আবার নতুন করে দিতে হচ্ছে মাটির প্রলেপ। কোথাও আবার মায়ের মাথায় প্লাস্টিক দিয়েছেন শিল্পীরা। অন্তত মাথা তো বাঁচুক। হাতে সময় কম, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কাজ। একই কাজে দু’বার করে সময় দিতে হচ্ছে যে।
যে পাড়ায় এখন সূর্যের আলোর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই পাড়াতেই সূর্যের আলো ঢোকার উপায় নেই। কারণ নিম্নচাপের বৃষ্টির চোখরাঙানি। মঙ্গলবার সূর্যদেব কিছুটা সহায় হয়েছিলে বনগাঁর পটুয়া পাড়ার শিল্পীদের ওপর। কিন্তু তাতেও প্লাস্টিকের আবরণ সরিয়ে খোলা আকাশে মূর্তি রোদে শুকোতে দিতে ভয় পাচ্ছেন শিল্পীরা। কখন বৃষ্টি শুরু হবে ভরসা নেই।
পটুয়া পাড়ার গলিতে চলছে নানা রঙের খেলা। কোথাও সাদা, কোথাও সবুজ, কোথাও কালো, কোথাও আবার কমলা। পুজোর আগে এমনই রঙ খেলা করে শিমুলতলার পটুয়া পাড়ার গলিতে। কিন্তু এটা প্রতিমার গায়ে চাপানো রঙ নয়, ত্রিপল-প্লাস্টিকের নানা রঙে ঢাকা পড়েছে পটুয়া পাড়া৷
কোথাও এখনও চলছে খড় বাঁধা, কোথাও কাঠামোর ওপর মাটির মূর্তি তৈরির কাজ। ঘড়ির কাঁটা দুপুর গড়ালেও খেতে যাওয়ার সময় হচ্ছে না, যে করেই হোক হাতের কাজ শেষ করতে হবে। শুধু বনগাঁ নয় বাংলা জুড়ে মৃৎশিল্পের খনিতে একই গল্প। বৃষ্টি বাঁচিয়ে কাজ করতে গিয়ে সময়ও নষ্ট হচ্ছে প্রচুর। হাতে যে আর মেরে কেটে মাত্র কয়েকটা দিন।
এখন কুমোর পাড়ার সবচেয়ে বড় অসুবিধা কাঁচা মাটি শুকনো করা। এদিকে যত দেরি হবে, প্রতিমা তৈরি করে মণ্ডপে পাঠাতে তত দেরি হবে। কাঁচা মাটিতে রঙ থাকবে না।
“অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে কাজের পরিস্থিতিও থাকে না। শুধু তো মাটি নয়, আনুসাঙ্গিক অনেক জিনিসের প্রয়োজন। যত সময় এগিয়ে আসছে চাপ বাড়ছে তত”, অসহায় কণ্ঠে জানালেন সেন্টু ভট্টাচার্য। বাবার হাতে হাতে কাজ করেন তিনি। চিন্তা একটাই, ঠাকুর সময়ে পৌঁছাতে পারবে তো মণ্ডপে?
শিল্পী স্বপন ভট্টাচার্যের কথায়, “কাজে ব্যাঘাত ঘটছে, তাতে যে সময়ে ডেলিভারি দেওয়ার কথা সেই সময়ে দিতে পারব না। দু’এক দিন দেরি হবে।” আবার যদি বৃষ্টি হয়? আঁতকে উঠে স্বপনবাবু বলেন, “মাথায় বাজ পড়বে। একেই কাজ শেষ করতে পারছি না। রাতেও কাজ করছি। আবার যদি বৃষ্টি পড়ে তখন কী করব জানি না।”
শিল্পী প্রদীপ ভট্টাচার্য জানালেন, ২০০০ সালের বন্যার পর থেকে বনগাঁ মহকুমার মৃৎশিল্প আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিভিন্ন সময়ে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে কাজ করতে হয়েছে কিন্তু কখনও বন্যা কখনও বা ঝড় আবার এখন বৃষ্টি তার সঙ্গে করোনা লোন শোধতো দূরের কথা এভাবে আর কতদিন বাঁচবে এই শিল্প সেটাই এখন বড় চিন্তার কারণ ৷
প্রতিটি প্রতিমা গড়ার কারখানায় হয় স্ট্যান্ড ফ্যান চালিয়ে নয়তো সিলিং ফ্যানের হাওয়ায় প্রতিমা শুকনো করার কাজ চলছে। তাতেও কী নিস্তার আছে! বাইরে থেকে শুকিয়ে উঠলেও ভেতরে কাঁচা থাকার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে শিল্পীদের মধ্যে।
বাতাসে যে আর্দ্রতা। সেখানে মাটি টানছে কম। তাহলে কি এবার মাটিতেই যাবে সব পরিশ্রম ! সেই ভাবনা এখন গ্রাম বাংলার সব প্রতিমা শিল্পীদের মনেই ৷ তবে মা আসছেন তাই তাঁরা দু’হাত দিয়ে প্রাণপন চেষ্টা করে চলেছেন মৃন্ময়ী মায়ের রুপ দিতে৷ তাই পটুয়াপাড়ার সমস্ত মৃৎ শিল্পীদের এখন একটাই প্রার্থনা ‘বৃষ্টি নয়, রোদ চাই’…