অশোক মজুমদার
নির্বাচনী প্রচার শুরু হবার পর থেকেই আমি নিজেকে খবরের কচকচানি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি সচেতন ভাবেই। কারণ একদিকে নির্বাচনের চাপ অন্যদিকে এই গরমে একজেলা থেকে অন্যজেলা ছুটতে হয় সময় ধরে যা প্রচন্ড কষ্টসাধ্য ও ক্লান্তির। তারপর দিনের শেষে নেতাদের কীর্তন শুনতে আর ইচ্ছে হয় না। কিন্তু টুকটাক খবর ঘনিষ্টজনদের থেকে ফোনে পাই। সেই সূত্রেই কয়েকদিন আগে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সম্মন্ধে বলা কুরুচিপূর্ণ কথাটি শুনলাম।
দীর্ঘ চার দশক সাংবাদিকতা করছি আমি। এত কুৎসা, এত অপপ্রচার, এত ব্যাক্তিগত আক্রমণ আমি এর আগে কোন ভোটে দেখিনি। দেশের মানুষ জানেন অপভাষার ব্যবহার এবং মহিলাদের সন্মানহানির ব্যাপারে বিজেপি ভারতের সব দলকে টেক্কা দিয়েছে। রাজ্য বিজেপির প্রধান দিলীপ ঘোষ তারই ফসল। কুমন্তব্য তার মুখে লেগেই থাকে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে সম্প্রতি তিনি এমন একটা মন্তব্য করেছেন যা শুনে লুম্পেনরাও লজ্জা পাবে! ভাঙা পা নিয়ে জননেত্রীর সারা বাংলা জুড়ে প্রচার বিজেপিকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। তাকে কিছুতেই আটকাতে না পেরে হতাশ দিলীপ তাকে বারমুডা পরার পরামর্শ দিয়েছেন! কেন তা লেখার মত বাক্য নয়। আপনারা তা জানেন। এই লোকটার রুচি ও ঔদ্ধত্য দেখে আমি অবাক হচ্ছি!
রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই নানা আক্রমণ, কুৎসা ও কুরুচিকর মন্তব্যের শিকার হয়েছেন বাংলার জননেত্রী। আন্দোলন করতে গিয়ে বহুবার মৃত্যুর মুখ থেকেও ফিরে এসেছেন তিনি। কিন্তু বর্তমানের মত কখনোই তা এত নিচে নামেনি! বিজেপি নিজেদের শৃঙ্খলাবদ্ধ দল বলে দাবি করে। যারা সর্বদা সনাতনী নীতিবোধের কথা বলে, সেই দলের এক রাজ্যনেতার মুখে এমন মন্তব্য শোভা পায় কিকরে ? এমন মন্তব্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো দূরের কথা, কোন মহিলার প্রতি করা যায়! দলের কেউ কী এব্যাপারে ওর নিন্দা করেছেন? সতর্ক করেছেন দিলীপ ঘোষকে? কিংবা নেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা? কিছুই হয়নি। এই হল বিজেপি। তাদের আচরণই সবকিছু বুঝিয়ে দেয়।
এই অশ্লীল মন্তব্যের পরেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দিলীপ ঘোষ! বোঝানোর চেষ্টা করছেন যা করেছি বেশ করেছি। এতে আদতে ক্ষতি হচ্ছে রাজনীতিরই। এমনিতেই রাজনীতি সম্পর্কেই সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক খারাপ ধারণা রয়েছে। দিলীপ ঘোষের মত লোকেদের এসব কুমন্তব্য তা আরও বাড়িয়ে দেয়। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে এসব মন্তব্য শুনে তার বাড়ির লোক বিশেষত মেয়েদের কী প্রতিক্রিয়া হয়? আমার বাড়ির কেউ একথা বললে আমি সর্বাগ্রে তাকে থাপ্পড় মারতাম।
কিন্তু সবথেকে বিরক্তির কথা হল, তার দলেরই একশ্রেণীর লোক ও সমর্থকরা এসব মন্তব্যকে সমর্থন করেন, বাহবা দেন। তাদের উৎসাহে এই শ্রেণীর নেতাদের বাড়বাড়ন্ত হয়। যারা এধরণের কথা বলেন তারা ভুলে যান কোন মহিলার বিরুদ্ধে অশ্লীল মন্তব্য সাধারণ মানুষ মানেন না। আর যারা হাততালি দেন তারা বিকৃতমনস্ক। তারা এসব শোনা পছন্দ করেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে জয়ললিতা, মায়াবতীদের প্রতি যত কুৎসা ও আক্রমণ হয়েছে ততই বেড়েছে তাদের জনপ্রিয়তা।
আজ দিলীপ ঘোষকে মনে করিয়ে দিই, রাজনীতি করার শুরু থেকেই বাংলার জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খারাপ কথা ও কুৎসার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যারা তার বিরুদ্ধে এসব বলেছিলেন তারা আজ কোথায় তা নিশ্চিত তিনি জানেন! সিপিএমের অনিল বসু, বিনয় কোঙার তারও আগের পর্বে হরেকৃষ্ণ কোঙাররা আলটপকা কুমন্তব্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এদেরকে মানুষ মনে রাখেননি। যদিও দিলীপ ঘোষ এদের স্তরের নেতাও নন। ২ মে’র পর তার আর কোন কাজ থাকবে না।
আসলে সমস্যাটা অন্য জায়গায়। বিজেপির হিন্দু সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিতেই মেয়েদের ছোট করার একটা প্রবণতা আছে। আদর্শগতভাবে এরা বলেন পুরুষ প্রাধান্যের কথা। হিন্দিবলয়ে মেয়েরা নিছকই খেলার বস্তু। দিলীপ ঘোষ ওই হিন্দিবলয়ের রাজনীতিরই এক বঙ্গীয় সংস্করণ। ওই কুকথা বলে তিনি আদতে বাংলার মেয়েদেরই অপমানিত করেছেন।
কিন্তু দিলীপ ঘোষ ও তার দল বিজেপি বাংলাকে এখনো পর্যন্ত চিনতে বুঝতে পারেননি। তারা জানেনা এই বাংলার মেয়েদের আত্মায় রামমোহন, বিদ্যাসাগররা শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন। এখানে মেয়েরা পণ্য নয় যে সম্মিলিত আক্রমনে তাদের সম্ভ্রম নষ্ট করে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়। এখানে মেয়েরা সুরক্ষিত। আর সেটা এবারের হাই ভোল্টেজ ভোটে আরও স্পষ্ট। কারণ এইবার শুধু দেশের নয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মহিলা রিপোর্টাররা বাংলার কোনে কোনে রাত দুটো তিনটের সময়ও নির্বিঘ্নে ঘুরছেন।
দিলীপ ঘোষদের দল বুক ফুলিয়ে শক্তি উপাসনার কথা বলেন। সেখানে বাংলার ঘরে ঘরে শক্তিরুপিনী মা দুর্গার পূজো হয়। দুর্গারূপেই মেয়েদের দেখা হয় এখানে। তিনি তো তার মন্তব্যে মা দূর্গাকেও অপমান করে বসেছেন। আর তাই মুখ্যমন্ত্রী তথা একজন মহিলাকে করা তার অশালীন মন্তব্য বঙ্গবাসী কীভাবে নিয়েছেন তা তিনি ভোটের ফল বেরোলেই টের পাবেন।