দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়া থানার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মালেয়াপুর থেকে গ্রেফতার হওয়া ২১ বছরের তরুণী তানিয়া পারভিনকে নিজেদের হেফাজতে নিল এনআইএ।
শুক্রবার সকালে এনআইএর তরফে বসিরহাট আদালতে তানিয়া পারভিনকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আবেদন জানায় এনআইএ। বিকেলে বসিরহাট আদালতের আবেদন মঞ্জুর হওয়ার পর দমদম সেন্ট্রাল জেলে আদালতের নির্দেশিকা নিয়ে পৌঁছন এনআইএর আধিকারিকরা। এরপর বিচারাধীন বন্দি তানিয়া পারভিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় নিউটাউন এনআইএর পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতরে।
বিকেল পাঁচটা থেকে প্রায় সোয়া এক ঘন্টা এনআইএর তদন্তকারী অফিসাররা ছিলেন দমদম সেন্ট্রাল জেলে। গত ১৮ মার্চ বাদুড়িয়ার বাসিন্দা তানিয়া পারভিনকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশের এসটিএফ। দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার লিঙ্কম্যান হিসেবে তানিয়া কাজ করত বলে অভিযোগ।
বছরখানেক ধরে তানিয়ার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেন নজরে এসেছিল অর্থমন্ত্রকের। বিদেশ থেকে আসা এই বিপুল অর্থের উৎস খুঁজতে যোগাযোগ করা হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সঙ্গে। শুরু হয় নজরদাবি। ধীরে ধীরে জাল গুটিয়ে এনে লস্কর-ই-তৈবার লিঙ্কম্যান সন্দেহে ১৮ মার্চ কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্কফোর্সের গোয়েন্দারা বাদুরিয়ার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে বসিরহাটের তরুণী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তানিয়া পারভিনকে।
গোয়েন্দাদের দাবি, প্রায় দু’বছর ধরে লস্কর-ই তৈবার সঙ্গে তানিয়ার যোগ। বাদুরিয়ার বাড়িতে বসে এলাকার মুসলিম যুবক যুবতীদের জঙ্গি কার্যকলাপে উদ্বুদ্ধ করত সে। এই কাজের জন্য বেশ কয়েকবার কাশ্মীর ও দিল্লিতেও গেছে এই তরুণী। বার কয়েক গেছে মুম্বইতেও। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এই পুরো তথ্য পাওয়ার পরেই যোগাযোগ করে কলকাতা পুলিশের এসটিএফের সঙ্গে।
তারপরেই বাদুরিয়ায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে এসটিএফ। তাঁর মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে পাকিস্তান-সহ আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগের কথা জানতে পারেন গোয়েন্দারা।
তানিয়ার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা ও ধর্মীয় উস্কানির বেশ কয়েকটি মামলা চলছে। বসিহাট মহকুমা আদালতের সরকারি আইনজীবী অরুণকুমার পাল জানান, দীর্ঘদিন ধরে মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে পাকিস্তান সব বেশ কিছু দেশের সঙ্গে ওই তরুণীর যোগাযোগের কথা জানতে পারে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ১২১এ, ১২৪এ ১২০বি, ৪১০/৪২০ সহ কয়েকটি ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ষড়যন্ত্র, অসামাজিক কাজকর্মের মামলা রুজু করা হয়েছে।
তাকে জেরা করে পাওয়া তথ্য অনুসন্ধান করবার জন্য এসটিএফ এনআইএর সাহায্য চায়। সেইমতো এনআইএ এদিন তানিয়া পারভিনকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করে এ রাজ্যে এই আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের জাল কতটা বিস্তৃত হয়েছে তা ক্ষতিয়ে দেখার কাজ শুরু করল।
এনআইএ মনে করে, দেশের তথ্য সে লস্কর–ই–তৈবাকে পাঠিয়েছে। তাদের পরামর্শমতো তথ্যও সংগ্রহ করেছে। ফের জেরার প্রয়োজন আছে। ‘ডার্ক ওয়েব’–এর মাধ্যমেই বাদুড়িয়া গ্রামের একটি ঘরে বসে লস্করের হয়ে কাজ করে গেছে। বাবা দিনমজুর। শান্ত স্বভাবের মেয়ে বলে পরিচিত ছিল। কলকাতার একটি কলেজে আরবি ভাষায় স্নাতকোত্তরের ছাত্রী ছিল। বাদুড়িয়ার ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াত। সেই মেয়েরই দুটি মোবাইলে মাসের খরচ কিনা কমবেশি ৭ হাজার টাকা!
লকডাউন শুরুর আগে রাজ্য পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গ্রেপ্তার করেছিল তানিয়াকে। অভিযোগ, জঙ্গি–যোগাযোগ। শুক্রবার জেরার জন্য তাকে ফের নিজেদের হেফাজতে নিল এনআইএ। ১৮ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করার পর এনআইএ ৮ এপ্রিল হেফাজতে নেয়। তানিয়ার জেল হেফাজত হয়। দমদম সংশোধনাগার থেকে শুক্রবার বিকেলে এনআইএ তাকে নিয়ে আসে। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, দিল্লি, মুম্বই–সহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে এসেছে তানিয়া। তার ভূমিকা কী, তা জানতেই আবার জেরার পর্ব শুরু হচ্ছে।
জানা গেছে, পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য নিরাপত্তা বিভাগও জেরা করবে। চলতি বছরের শুরুতেই বেশ কয়েকটি ফোন নম্বরের ওপর নজরদারি শুরু করে এনআইএ। পাশাপাশি রাজ্য পুলিশের নজরেও আসে কয়েকটি ফোন নম্বর। শুরু হয় ফোনে আড়িপাতা। দেখা যায়, পাকিস্তানের কয়েকটি জায়গায় দুটি ফোন নম্বর থেকে মাঝে মাঝেই ফোন যায়। ওই ফোন নম্বরের সূত্র ধরে ভয়েস রেকর্ড করা শুরু করেন গোয়েন্দারা। বাদুড়িয়া থেকে পাকিস্তান, কাশ্মীরে ঘন ঘন ফোন যায় কেন? সেই সূত্র সন্ধান করতে গিয়েই দেখা যায়, তানিয়া পারভিনই তার দুটি মোবাইল থেকে আইএসডি ফোন করে।
গ্রামের বাড়ি থেকে তাকে নিয়ে আসার সময় তার একটি ডায়েরি পাওয়া যায়। কিছু সাঙ্কেতিক শব্দ, ফোন নম্বর, ঠিকানা মিলেছে বলে গোয়েন্দারা আগেই দাবি করেছিলেন। তানিয়ার দুটি ফোন নম্বরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, বহু টাকা মাসে খরচ হত অন্য দেশে ফোন করতে। একজন দিনমজুরের ঘরের পড়ুয়ার এত টাকা ফোন খরচ কোথা থেকে আসে? পাশবই ঘেঁটে দেখা গেছে, মাসে মোটা অঙ্কের টাকা তার অ্যাকাউন্টে জমা হত বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে।
হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় ৮০ শতাংশ নম্বর পেয়েছিল তানিয়া। মেধাবী এই ছাত্রী জঙ্গিদের খপ্পরে কী করে পড়ল, তা নিয়েই গোয়েন্দাদের মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে।