দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর চিনের সঙ্গে উত্তেজনা যখন চরমে, ঠিক সেই পরিস্থিতিতেই আজ বুধবার থেকে উচ্চ পর্যায়ের সেনা কমান্ডারস কনফারেন্স শুরু হচ্ছে দিল্লিতে।
আপাত ভাবে চলতি সীমান্ত উত্তেজনার সঙ্গে এই কমান্ডারস কনফারেন্সের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। কারণ, বছরে দু’বার এমনিতেই সেনা কমান্ডারস কনফারেন্স হয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওয়ার রুমে। যেখানে নিরাপত্তা সংক্রান্ত নতুন চ্যালেঞ্জ, তার মোকাবিলা, আধুনিকীকরণ, প্রশাসনিক সমস্যা ইত্যাদির ব্যাপারে সবিস্তার আলোচনা করেন শীর্ষ সেনা কর্তারা।
তবে সাউথ ব্লকের কর্তাদের মতে, চলতি পরিস্থিতির প্রসঙ্গ অবধারিত ভাবে ওই বৈঠকে উঠে আসবে বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, চিনের সঙ্গে সীমান্তে নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও তার থেকে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ নিয়ে নয়াদিল্লিকে ভাবতে হবে বইকি।
এ বছর সেনা কমান্ডারস কনফারেন্স এপ্রিল মাসে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিডের সংক্রমণের জন্য তা পিছিয়ে গিয়েছে।
সাউথ ব্লকে আজ থেকে শুক্রবার পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ের এই কনফারেন্সে মূলত অপারেশনাল এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ তথা প্রশাসনিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। অপারেশনাল ইস্যুর মধ্যেই লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পরিস্থিতি এবং ভারত পাক সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সেই সঙ্গে উঠে আসতে পারে কাশ্মীরে সন্ত্রাসদমন কার্যকলাপের প্রসঙ্গ। সম্প্রতি এ ব্যাপারে বড় সাফল্য পেয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী।
সাউথ ব্লক সূত্রের মতে, প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের আমদানি ও ঘরোয়া উৎপাদনের ব্যাপারেও কমান্ডারস কনফারেন্সে আলোচনার কথা রয়েছে। এ মাসের গোড়াতেই সরকার ঘোষণা করেছে যথাসম্ভব প্রতিরক্ষা আমদানি কমাতে হবে। বরং ঘরোয়া উৎপাদনের উপর জোর দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়। যদিও প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ও সেনা কর্তাদের অনেকের মতে, কিছু অত্যাধুনিক সরঞ্জাম আমদানি করা ভিন্ন পথ নেই। দেশের উৎপাদন কবে হবে সে জন্য অপেক্ষা করে থাকা বুদ্ধিমত্তা হবে না।
এরই মধ্যে চিনা প্রেসিডেন্টের মন্তব্য পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। আজ চিনফিং বলেন, ‘‘সেনাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে হবে। সে জন্য সামগ্রিক প্রশিক্ষণ জরুরি।’’ চিনের ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষা’ এবং ‘দেশের কৌশলগত স্থিতিশীলতার জন্য’ যুদ্ধের প্রস্তুতি রাখতে সেনাকে নির্দেশ দিয়েছেন চিনফিং। চিনা সেনার একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার সময়ে এই মন্তব্য করেছেন চিনের সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান শি। কূটনীতিকদের মতে, করোনা নিয়ে মার্কিন দোষারোপ, তাইওয়ান পরিস্থিতি এবং ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতের বাতাবরণে সেনাকে বার্তা দিতে চেয়েছেন তিনি। ক’দিন আগে চিনের তরফে অভিযোগ করা হয়েছিল, করোনা সংক্রমণের দায় চাপিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে আমেরিকা।
নয়াদিল্লিতে যখন এই তৎপরতা, তখনই চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং আজ সে দেশের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। ‘যুদ্ধের প্রস্তুতি রাখতে চিনা সেনার প্রশিক্ষণ বাড়ানো’-র উপরে জোর দিয়েছেন তিনি। করোনা বিপর্যয় নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে চিনের উপরে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং ভারতের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে যে ভাবে নতুন করে টানাপড়েন শুরু হয়েছে, সেই প্রেক্ষিতেই শি-র বক্তব্যের ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ লাদাখের পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়ত ও তিন সামরিক বাহিনীর কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তার আগে মোদী ও রাজনাথ সামরিক বাহিনীর কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর কথা হয়েছে। আগামিকাল সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজমুকুন্দ নরবণেও বাহিনীর শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
তিব্বতের গারি গুনশা ঘাঁটিতে বড় মাপের নির্মাণকাজ চালাচ্ছে চিন। তারই প্রমাণ উপগ্রহ চিত্রে। ( বাঁ দিকে, ৬ এপ্রিল, ২০২০, ডান দিকে, ২১ মে, ২০২০)
ভারত-চিন সীমান্তের তিনটি সেক্টরই এখন উত্তপ্ত। গত ৫ মে থেকেই পশ্চিম ভাগে বা ওয়েস্টার্ন সেক্টরে লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সংঘাত চলছে। ‘ফিঙ্গার থ্রি’ ও ‘ফিঙ্গার ফোর’-এর মধ্যে রাস্তা তৈরির কাজে চিন প্রথম আপত্তি তোলে। একই সঙ্গে গালওয়ান ভ্যালির সঙ্গে সংযোগকারী রাস্তার কাজেও চিনের আপত্তি। ৫ মে রাতে পূর্ব লাদাখের প্যাঙ্গং লেকের কাছে চিন ভারতীয় সেনার নজরদারি বাহিনীকে বাধা দেয়। তার পর থেকেই ওই দু’টি এলাকায় দু’দেশের সেনা পরস্পরের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পূর্ব ভাগে বা ইস্টার্ন সেক্টরের উত্তর সিকিমেও এ মাসের শুরুতে দুই সেনাবাহিনীর সংঘাত বেধেছে। সাধারণত সেন্ট্রাল সেক্টরের উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশের অংশ শান্ত থাকে। কিন্তু সেখানেও বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে।
রাজনাথের সঙ্গে সামরিক কর্তাদের বৈঠকে এই পরিস্থিতির পর্যালোচনা হয়। বিপিন রাওয়ত ও তিন সামরিক বাহিনীর প্রধানরা বৈঠকে হাজির ছিলেন। আলোচনা চলে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। ভারতের সেনাবাহিনী কী ভাবে চিনের সেনার রণমূর্তি সামাল দিচ্ছে, তা নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। ঠিক হয়েছে, এই বিবাদের মীমাংসা একমাত্র আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব। কূটনৈতিক স্তরেই এর সমাধান সম্ভব। কিন্তু যত দিন তা না-হচ্ছে, তত দিন ভারতীয় সেনা নিজের অবস্থান থেকে নড়বে না। চিন যদি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে আরও বেশি সেনা ও যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েন করে, ভারতও পাল্লা দিয়ে সেনা-যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েন করবে। সেনা সূত্রের খবর, উপগ্রহ চিত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে চিন প্রায় হাজার দশেক সেনা মোতায়েন করেছে। তিব্বতের গারি গুনশা ঘাঁটিতে চলছে নির্মাণকাজ। সেখানে হাজির বেশ কিছু যুদ্ধবিমানও। গত কাল ভারত থেকে নিজেদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ারও প্রস্তাব দিয়েছে চিন।
প্রসঙ্গত, গত ২২ মে সামরিক খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে ১৭৯ বিলিয়ন ডলার করেছে চিন। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে ১৩ লক্ষ কোটি টাকা এবং ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেটের তিনগুণ।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, লাদাখ সীমান্তে ভারতের সঙ্গে যেমন সামরিক উত্তেজনা বাড়িয়েছে চিন, তেমনই চিনের উদ্বেগও কম নয়। বিশেষ করে ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ চিন সাগর, তাইওয়ান স্ট্রেইটে চিনের বাণিজ্য সুরক্ষিত রাখা নিয়ে চাপ রয়েছে বেজিংয়ের। দক্ষিণ চিন সাগর এবং তাইওয়ান স্ট্রেইটে মার্কিন নৌবাহিনী ইতিমধ্যে তাদের টহলদারি বাড়িয়েছে। চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই রবিবার স্পষ্টতই বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শীত যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তি। হতে পারে কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কিছুটা কোণঠাসা হয়েই সামরিক প্রস্তুতি বাড়ানোর কথা বলেছেন চিনা প্রেসিডেন্ট।