দেশের সময় ওয়েবডেস্ক:২৪ ফেব্রুয়ারির সকাল। গোকুলপুরীর রাস্তা তখন রণক্ষেত্র। দু’পাশে সারি সারি দোকান জ্বলছে। রাস্তার মাঝে শুয়ে কাতরাচ্ছেন এক যুবক। গুলি বিঁধেছে হাতে, পিঠে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। স্কুটির মুখ ঘুরিয়ে ছুটে গেলেন মহীন্দর। পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে।
প্রাণ বাঁচল যুবকের। ৫৩ বছরের মহীন্দর সিং। গোকুলপুরী, কারদামপুর-সহ গোটা উত্তর-পূর্ব দিল্লিই এখন তাঁকে চেনে ‘হিরো’ মহীন্দর নামে। ছোটখাটো দোকান আছে। সেটাই পেশা। নেশা মানুষের প্রাণ বাঁচানো। গত পাঁচদিনে ডজনখানেক মুসলিম ভাইয়ের প্রাণ বাঁচিয়েছেন উন্মত্ত বিক্ষোভকারীদের কবল থেকে। রাস্তা থেকে জখম হিন্দু ভাইয়ের তুলে নিয়ে গেছেন হাসপাতালে।
ধর্ম দেখি না। মৃত্যুর কবল থেকে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। মুমূর্ষুদের পাশে দাঁড়াই,” বললেন মহীন্দর। দিল্লির হিংসা তাঁকে ১৯৮৪ সালের শিখ বিরোধী দাঙ্গার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। মহীন্দর তখন তেরোর কিশোর। চোখের সামনে শয়ে শয়ে শিখ ভাইয়ের মরতে দেখেছেন। “দাঙ্গার বীভৎস চেহারা আজও চোখে ভাসে। সেই রোষ, সেই অশান্তির আগুন, সেই গণহত্যা—এমনভাবে মানুষকে মরতে দেওয়া যায় না। যতজনের পারব প্রাণ বাঁচাব, “ এমনই শপথ নিয়েছেন মহীন্দর। দাঙ্গা-বিধ্বস্ত দিল্লিতে তিনি এখন উদ্ধারকর্তা। কারও কথায় নয়, স্বার্থের প্রয়োজনেও নয়, শুধু একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ছুটে চলেছেন।
মহীন্দর একা নন, এই কাজে সঙ্গী তাঁর ছেলে ইন্দ্রজিৎ । প্রতিদিন ভোর হতেই মহীন্দর স্কুটিতে আর তাঁর ছেলে বুলেট মোটরবাইকে চেপে বেরিয়ে পড়েন। ঘুরে বেড়ান উত্তর-পূর্ব দিল্লির এ গলি থেকে ও গলি। অসহায়, আহত মানুষজন দেখলেই তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। মহীন্দর বলেছেন, “গোকুলপুরী থেকে কারদামপুরে এক ঘণ্টা ধরে ২০টা ট্রিপ করি আমরা। মুসলিম মহল্লায় ঘুরে ঘুরে ডজনখানেক মানুষকে উদ্ধার করেছি। প্রত্যেকের অবস্থাই ছিল আশঙ্কাজনক।
কারও শরীরে বিঁধেছিল গুলি, কাউকে কোপানো হয়েছিল এলোপাথাড়ি।” মুসলিমদের উদ্ধারের জন্য অনেক বাঁকা কথাও শুনতে হয়েছে মহীন্দরকে। বলেছেন, “আমি ধর্ম দেখে প্রাণ বাঁচাই না। অনেক হিন্দু মা-বোনেদেরও উদ্ধার করেছি। দাঙ্গার ভেতর থেকে বার করে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছি।”
প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে অনেক ভয়াবহ ঘটনারও সাক্ষী হতে হয়েছে মহীন্দরকে। বলেছেন, চোখের সামনে দেখতে হয়েছে নিষ্ঠুর হত্যালীলা। কিশোর, শিশুদেরও ছাড়ছিল না দাঙ্গাকারীরা। সর্দারজির কথায়, “ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল ওরা আমারই সন্তান। কোনও দোষ ছাড়াই হিংসার বলি হচ্ছে। ওদের অনেককে উদ্ধার করেছি নিষ্ঠুর বিক্ষোভকারীদের হাত থেকে।”
কারদামপুরে বিক্ষোভকারীদের গুলি লেগে জখম হয়েছিলেন এক যুবক, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও বাঁচানো যায়নি বলেছেন মহীন্দর। চোখের সামনে ছটফট করতে থাকা সেই যুবককে দেখে প্রাণ বাঁচানোর অঙ্গীকার আরও দৃঢ় হয় তাঁর। মহীন্দর বলেছেন, “প্রচারে আসার জন্য করছি না। শুধু মায়ের কোল শূন্য হতে দেব না। একটি বাচ্চা ছেলে আমাকে এসে বলল, সে একজন সর্দারজির নাম জানে যে মুসলিম ভাইদের বাঁচায়। এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।