অপরূপ কুমায়ুন (পঞ্চম পর্ব)
দেবাশিস রায়চৌধুরী
আকাশের মতো সকলের মনেও যে রঙ লাগছে সেটা বেশ বোঝা গেল।গতকাল সকালে আলমোড়ায় হোটেলের ছাদে কয়েকজন মাত্র হাজির ছিলাম।আজ সকালের ছবি একেবারে অন্যরকম।আমদের প্রায় সকলেই আজ ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আসলে গতরাতে আলোআঁধারিতে পাহাড়ের যে রূপ প্রত্যক্ষ করা গেছে তাতে সকলের প্রত্যাশার পারদ পাহাড় প্রমাণ হয়েছিল।পঞ্চচুল্লি মুন্সিয়ারি/হাত বাড়ালে ছুঁতেই পারি—,মনে মনে অনেকেই এরকম ভেবে রেখেছিল বোধ হয়।আজ সকালে এখানে শীতল হাওয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে। চার ডিগ্রি তাপমাত্রা চারিয়ে যাচ্ছে হাড়ে হাড়ে।যাবতীয় বিরূপতা উপেক্ষা করে পঞ্চচুল্লি দেখার জন্য ছাদে প্রায় সবাই চলে এসেছে।আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে সরাসরি সূর্যোদয় মুহুর্তের সাক্ষী থাকা যাবে না জানি।সেই আলোকসামান্য আলোক উদ্ভাস সঞ্চারিত হচ্ছে দূরে কাছের বরফশৃঙ্গে।যেন দূরাগত কোনও আলোর ঢেউ এসে ভাসিয়ে দিল চারিধার।এই সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা সাধ্যাতীত। এতক্ষণ সূর্যের দেখা পাওয়া যায়নি।আলোয় গিরি-তাজ ঝলমল করে উঠতেই চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে প্রকাশিত হলেন তিনি অর্থাৎ দিবাকর।ইতিমধ্যে চাসজ্জিত সুকুমার গরম শয্যা-চা নিয়ে হাজির।অন্য দিনের মতো আজ অবশ্য তাকে দোরে দোরে ঘা দিয়ে বলতে হয়নি, “বেডটি এসে গেছে “। হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে,” এক ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে লাগেজ ঘরের বাইরে বের করে দেবেন নয়তো বেরোতে দেরি হয়ে যাবে “বলে তাগাদা দিতে হয়নি।আজ সবাইকে ছাদে পেয়ে গেল।চায়ের কাপ হাতে হয়ে গেল এক টুকরো আড্ডা ।আজ আমরা বেশ রিল্যাক্সিং মুডে।গত পাঁচদিন সকাল থেকে রাত টানা জার্নি চলছে।আজও মুন্সিয়ারি থাকা হবে তাই সকাল থেকে বেশ আড্ডা আড্ডা পরিবেশ।ছবি তোলা,হৈহল্লা পর্বের মধ্যেই জলখাবার খাওয়ার ডাক এল।হারুদা জানালেন এই পর্ব শেষ হলে নন্দাদেবী মন্দির দেখতে যাওয়া হবে।
আমাদের হোটেল থেকে মন্দির খুব একটা দূর নয়।এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে।যাওয়ার রাস্তাটা খুব সুন্দর। দুপাশেই জঙ্গল।গাছপালার ফাঁক দিয়ে মাঝেমাঝেই দেখা যাচ্ছে বরফমোড়া পাহাড় সারি। বাস আমাদের নামিয়ে দিল মন্দিরের তোরণদ্বারের সামনে।তোরণের উপরে লেখা ‘জয় মা নন্দা’।এখান থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে মন্দিরের দিকে।সিঁড়ি বেয়ে প্রায় দুশো মিটার চড়াই পেরিয়ে মন্দির চত্ত্বর।উঠতে খুব একটা অসুবিধা হয় না।জঙ্গল ঘেরা নির্জন পাহাড়ি পথে হাঁটতে বেশ ভালোই লাগে। নাম না জানা পাখির ডাক শহুরে মন উদাস করে দেয়।দিনের বেলাতেও একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শৈশবের নিঃঝুম রাতের স্মৃতি ফিরিয়ে দিল।উপরে উঠে ভালোলাগায় মন আচ্ছন্ন হয়।সামনে খানিকটা সবুজ সমতল।যত্নে সাজানো ফুল বাগানে ফুটেছে অজস্র রঙিন ফুল।বাগানের মাঝ বরাবর পথ পৌঁছেছে মন্দিরে।নন্দাদেবী কুমায়ুন অঞ্চল জুড়ে পূজিত হন।মুন্সিয়ারি ছাড়াও আলমোড়া,নৈনিতাল,বৈজনাথ,বাগেশ্বর,
রাণীক্ষেতেও নন্দাদেবীর মন্দির আছে।নন্দাদেবীর আর এক নাম পার্বতী।পর্বতের কণ্যা বলেই এমন নামকরণ।তাঁকে শৈলপুত্রী নামেও ডাকা হয়।
মন্দির চত্ত্বর থেকে পঞ্চচুল্লিকে যেন আরও কাছে মনে হয়।নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে হয়। দেখে আশ মেটে না।সামনে কিছুটা এগিয়ে গেলে আবার পথ গড়িয়েছে নীচের দিকে।ধাপে ধাপে নেমে গেলে নদী।অল্পবয়সীরা হৈচৈ করতে করতে নেমে গেছে সে পথ বেয়ে।আমরা যারা সাহসী হতে পারিনি তারা অপেক্ষায় থাকলাম।অনেকটা সময় কেটে যায়।যারা নদীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল তারা নদীর প্রেমে পড়ে গিয়ে ফেরার কথা ভুলে বসেছে।অনেক ডাকাডাকি করে তাদের ফেরাতে হয়।তবে পাহাড়ি নদীর উদ্দামতা তাদের সঙ্গী হয়ে চলে আসে।ফলে ফেরার সময় বাস কিছুটা যেতে না যেতেই ফের তারা নেমে পড়ে।আমাদের টা টা করে তারা হেঁটে হেঁটে হোটেলে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়।
হোটেলে ফিরে কেউ কেউ ট্রাইবাল হেরিটেজ মিউজিয়াম দেখতে গেলেন।আমাদের ইচ্ছে ছিল আদিবাসী গ্রাম দারকোটে যাবার।হোটেলের কর্মচারীরা জানালেন যেখানেই যাওয়া হোক না কেন পাঁচটার মধ্যে হোটেলে ফিরে আসতে হবে,তা না হলে সূর্যাস্ত দেখা যাবে না।দুপুরের খাওয়া শেষ হতে বেলা গড়িয়ে গেল অনেকটা ফলে দারকোট যাবার পরিকল্পনা বাতিল করতে হল।
বিকেল পাঁচটা বাজার আগে থেকে ছাদের জমায়েত শুরু হয়।নাটক শুরু হওয়ার আগে মঞ্চের সামনে উৎসুক দর্শকদের মতো প্রতীক্ষায় থাকি।পঞ্চচুল্লির চূড়াগুলো দেখিয়ে হোটেলের একজন যুধিষ্ঠির, ভীম,অর্জুন,নকুল, সহদেব এইভাবে চিনিয়ে দিচ্ছিল।চতুর্থ আর পঞ্চম চূড়ার পিছনে একটা চূড়া দেখিয়ে জানাল ওটা দ্রৌপদী।যদিও ওই চূড়াকে ভৌগলিকভাবে পঞ্চচুল্লির মধ্যে ধরা হয় না। কথিত আছে পান্ডবরা মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা শুরু করার আগে এখানেই শেষবারের মতো রান্না করে খেয়ছিলেন।চুল্লি শব্দের অর্থ উনুন। পান্ডবরা যে পাঁচটা উনুনে রান্না করেছিলেন সেই পাঁচটা চুল্লিই হল পঞ্চচুল্লি স্থানীয় মানুষেরা এমনটাই বিশ্বাস করেন।সেইজন্য স্থানীয় মানুষজন পঞ্চচুল্লিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন।এইসব কথা শুনতে শুনতেই দেখি পঞ্চচুল্লিতে রঙের খেলা আরম্ভ হয়ে গেছে।একের পর এক চূড়ায় কমলা,সোনালী,লাল রঙ ছড়িয়ে পড়তে লাগল।পাহাড়ের সাথেসাথে আকাশের রঙ বদল হচ্ছে।চোখের সামনে চলছে এক অপার্থিব হোলি উৎসব। এক অবর্ণনীয় মহান দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে মনে হল এতদিনের যাবতীয় গ্লানি ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল।পঞ্চচুল্লির রঙ এখন টকটকে লাল আক্ষরিক অর্থে যেন আগুনের চুলা হয়ে উঠেছে।আস্তে আস্তে সে ঔজ্জ্বল্য কমে এল।যদিও আকাশ তখনও রঙিন।একে একে সবাই ঘরমুখী হয়।পূর্ণ প্রস্তাব রাখে সন্ধ্যায় একটু গানবাজনার আসর হোক।যেহেতু ভবানীদের ঘর তুলনামূলকভাবে বড় তাই ঠিক হয় সান্ধ্য আড্ডা ওখানেই হবে।আমরা দুজন বাদে রেডি হওয়ার জন্য যে যার ঘরে ঢুকে যায়।
আমরা অপলক চেয়ে থাকি বিস্তৃত পর্বতশ্রেণীর দিকে। আকাশের রঙ ক্রমে মুছে যায়।পাহাড়ি সন্ধ্যা ঝুপ করে নেমে আসে।বাতাসের শীতল কামড় টের পাওয়া যায়।”এবার ঘরে এসো ঠান্ডা লেগে যাবে”,ডাক দিয়ে পার্শ্ববর্তীনী ঘরে ঢুকে যায়।চেয়ারে বসে দেখি সন্ধ্যার ঘোরলাগা পাহাড়গুলো আর অবধারিত ভাবে মনে পড়ে যায় লাইনগুলো, —
” সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার..
“
না,এখানে কোনও বনলতা সেন নেই। আমি পঞ্চচুল্লির মুখোমুখি আরও গাঢ় হয়ে বসি।
(ক্রমশ)
ছবি ঃ সূপর্ণা রায়চৌধুরী।