
কলকাতা: সম্প্রতি কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার খিলাত ঘোষের বাড়িতে প্রদর্শিত হল ২০০ বছরের পুরনো বাংলায় ছাপার হরফ। বাংলায় ছাপার হরফের জনক বলা হয় শ্রীরামপুরের পঞ্চানন কর্মকারকে। তাঁরই পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম প্রিয়াঙ্কা কর্মকার সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরলেন প্রাচীন ছাপা অক্ষরের এই ইতিহাস। যারমধ্যে রয়েছে বাংলা, দেবনাগরীসহ পঞ্চানন কর্মকারের হাতে তৈরি প্রায় ৩০০টি ছাপার হরফ, সেই সময়কার ব্যবহৃত পুঁথি, দুষ্প্রাপ্য কিছু লিপি, ছাপার কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র এবং আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র।

পঞ্চানন কর্মকারের পঞ্চম প্রজন্ম প্রিয়াঙ্কা কর্মকার জানালেন , পঞ্চানন কর্মকার বাংলা ছাপার হরফের জনক হলেও সাধারণ মানুষ তার সম্পর্কে অবহিত নন যতটা উইলিয়াম কেরি কিংবা গুটেনবার্গের ছাপাখানা সম্পর্কে। বাংলার সেই ইতিহাসকেই মানুষের কাছে তুলে ধরা এবং তাকে সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই তার এই প্রদর্শনী। খিলাত ভবনে কৌন্তেয় সিনহার তত্বাবধানে ‘হরফ’ নামক এই প্রদর্শনীটি চলবে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত। দেখুনভিডিও

অক্ষর শহর হিসাবে পরিচিত হুগলির শ্রীরামপুর৷ কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বাংলা ভাষায় ছাপার জন্য বাংলা হরফের জন্ম হয়েছিল তৎকালীন হুগলি আর বর্তমানের চুঁচুড়া শহর থেকেই। সেটা শ্রীরামপুরে ছাপাখানা তৈরির অনেক আগেই। ইংরেজ আমলে চার্লস উইলকিন্স ছাপাখানা তৈরি করেছিলেন চুঁচুড়া শহরে৷ গুটেনবার্গের টেকনোলজিতে পঞ্চানন কর্মকারকে সঙ্গে নিয়েই বাংলার ভাষার হরফ তৈরি হয়েছিল। পঞ্চানন কর্মকারের হাতে বাংলায় ছাপার হরফের জন্ম হুগলিতে৷ তার প্রমাণ পাওয়া যায় ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হালহেডের লেখা ‘অ্যা গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ বইয়ে। সেই বইয়ের তলায় ইংরেজিতে লেখা, প্রিন্টেড অ্য়াট হুগলি ইন বেঙ্গল।
তৎকালীন সময় গোটা চুঁচুড়া শহর ও হুগলি, জেলা হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি। ব্যান্ডেল ও চুঁচুড়ার মাঝের জায়গা হুগলি নামেই প্রসিদ্ধ ছিল। পুরনো বই থেকে পাওয়া তথ্য ও ইতিহাসবিদদের মতে, ১৭৭৮ সালে বাংলা ভাষার হরফের জন্ম হয়। এর প্রথম পথ চলা শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে হুগলি থেকে।
পরবর্তীকালে ১৮০০ সালে শ্রীরামপুরে উইলিয়াম কেরির হাত ধরে ছাপাখানা তৈরি হয়। সেখানেও পঞ্চানন কর্মকার ও তাঁর জামাই মনোহর কর্মকার বাংলা হরফকে আরও উন্নত করেন। রামায়ণ, মহাভারত থেকে বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্র-সহ একাধিক ভাষায় বই ছাপানো হয়।

ভারতবর্ষে বেশ কয়েকটি ছাপাখানা তৈরি হলেও বাংলা ভাষায় প্রথম প্রেস হয়েছিল হুগলি জেলাতেই। ইংরেজ শাসনকালে দেশীয় ভাষা শেখা ও বাংলা ভাষা শেখার তাগিদ হয় সাহেবদের। তার থেকেই বাংলা ভাষায় গ্রামার বই ছাপানো হয়। কিন্তু এও শোনা যায়, পর্তুগালে কয়েকটি পুস্তকে কিছু অংশ বাংলা হরফে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তীকালে হুগলি ও তারও পরে শ্রীরামপুরের ছাপাখানা তৈরি হয়।
১৮০০ সালে ইউলিয়াম কেরির তত্ত্বাবধানে শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেস থেকে বাংলা হরফে ছাপা শুরু হয়। সেখানে মূল কাণ্ডারী ছিলেন পঞ্চানন কর্মকার ও মনোহর কর্মকার। তাঁরাই বাংলা ভাষায় একাধিক বই ছাপানোর ইতিহাস তৈরি করেন। এছাড়াও ১৪টি ভাষায় বই ছাপানো হয়েছিল শ্রীরামপুরে। পরে পঞ্চানন কর্মকার শ্রীরামপুর বটতলার কাছে নিজের বাড়িতে ছাপাখানা তৈরি করেছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজে পঞ্চানন কর্মকারের বাড়িতে বসেই কীভাবে বাংলা হরফগুলির সাধারণীকরণ করা যায়, তা নিয়ে বিস্তর কাজ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজে হাতে একটি ডায়াগ্রাম তৈরি করে দিয়েছিলেন, যা দেখে তৈরি হত বিভিন্ন হরফ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবাব আলিবর্দী খানের কাছে ধাতুর উপর খোদাইয়ের কাজ করত পঞ্চানন কর্মকারের পূর্বপুরুষ। তাদের থেকেই মল্লিক উপাধি পেয়েছিল কর্মকার পরিবার৷ পরবর্তীকালে কর্মকার পরিবার হুগলির বলাগড়ের জিরাটে চলে আসে। সেখানেই জন্ম হয় পঞ্চানন কর্মকারের। বাঁশবেড়িয়ার জমিদার পূর্ণেন্দু রায়ের বাড়িতে ধাতুর উপর লেখার কাজ করতেন পঞ্চানন। সেখান থেকেই চার্লস উইলকিন্স পঞ্চাননকে নিযুক্ত করেন বাংলায় হরফ তৈরির কাজে।

চুঁচুড়ায় ওয়ারেন হেস্টিংসের নির্দেশে হালহেডের বাংলায় গ্রামার বই ছাপানোর কাজে নিযুক্ত করা হয় তাঁকে। এরপর তিনি মারা যাওয়ার ঠিক চার বছর আগে শ্রীরামপুরে উইলিয়াম কেরির হাত ধরেই মিশন প্রেসে কাজ শুরু করেন। পরে নিজের বাড়িতে ছাপাখানা তৈরি করেন ৷ ১৯৯০ সালে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় শ্রীরামপুরের সেই ছাপাখানা৷