“এই যে দাদা আপনি আমার ছবি তুলছিলেন না”- চমকে উঠে দেখলাম আরে ওই মেয়েটাই তো যার ছবি একটু আগে তুলেছি।
মেয়েটি কিন্তু না থেমেই জিজ্ঞাসা করে চলেছে পরপর- “আপনি কি ইন্ডিয়ান ?”
কোথায় থাকেন ?
এবার বললাম “কলকাতা।”
শুনে ততোধিক উৎসাহে বলে উঠলো-” ওহ কলকাতা, সেতো আমাদেরই দ্যাশ, হ্যাইটাই চইলা যাওয়া যায়। যাক শোনেন, আমার কিছু ছবি তুইল্যা দ্যান।”
আমি বললাম-“তুলেছি তো, তোমার ঠিকানা দাও, আমি কলকাতা ফিরে পাঠিয়ে দেবো।”
মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে ছটফটিয়ে বলে উঠলো-“নানা ওই ছবি আমার অনেক আসে, আমি জাহাজের ওই কোনায় গিয়া দাঁড়ামু, আপনি ওই ছবি তুইল্যা দ্যান।”
আমি বললাম-“ওরকম ছবি তোলার কি দরকার, যদি পড়ে যাও।”
ঘটনা বাংলাদেশে। বিখ্যাত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফার শহিদুল আলমের প্রতিষ্ঠিত ‘দৃক’ ফটো গ্যালারির আমন্ত্রণে এশিয়ান কান্ট্রির সব দেশ নিয়ে ঢাকায় আয়োজিত সেমিনার ও ওয়ার্কশপে গিয়েছিলাম। ছবি তোলা ছাড়াও কবিতা, ডকুমেন্টারি ইত্যাদি নিয়েও আলোচনা হয়েছিলো। সাথে ছিলো সৌমিত্র, আমার বিশেষ বন্ধু ও ফটোগ্রাফার। ফোটোগ্রাফি ছাড়া ওরও শিল্প, সাহিত্য নিয়ে কথা বলা খুব পছন্দের ছিলো। ও খুব ভালো আবৃত্তিও বলতে পারতো। বুড়িগঙ্গার উপরে বিলাসবহুল লঞ্চে বিয়ার খেতে খেতে সৌমিত্র আর আমি এইসব নিয়েই গল্প করছিলাম। নিচ থেকে অনেকক্ষন ধরে হিন্দি গানের কলি ভেসে আসছিলো শুনে আমি ক্যামেরা হাতে নিচে গিয়ে দেখলাম একটি বছর আঠারোর ত্বন্হী সুন্দরী মেয়ে গান করছে। আমি পিছন থেকেই কটি ছবি তুলে আবার ফিরে যাই চারতলা লঞ্চটির ছাদে সৌমিত্রের কাছে। তখনই গল্পের মধ্যে মেয়েটি এসে হটাৎ ওই কথা বলতে থাকে।
কথোপকথনের মধ্যে ততক্ষণে মেয়েটির মা এসে আরও জোরাজুরি করতে লাগলেন,” মেয়ের অবদার মিটায় দ্যান।”
এতক্ষন ধরে সব দেখেশুনে সৌমিত্র বলে উঠলো-” ওইরকম ছবি তোলার ইচ্ছে কেন।”
মেয়েটি আরও লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলো,- “ওমা সেকি! টাইটানিক দ্যাখেন নাই। আমি ঐ মাথায় গিয়া পোজ দেবো। আপনি ওই ছবি তুইল্যা পাঠাইবেন।”
আমাদের দুজনেরই তখন বেশ মজা লাগছে। আমি সৌমিত্রকে ক্যামেরা দিয়ে বললাম তুলে দেবার কথা। ও দেখলাম সভয়ে বলে উঠলো,-” ওই ধারে গিয়ে আমি তুলতে পারবো না, তুমি তুলে দাও।”
অগত্যা টাইটানিকের রোজের সেই বিখ্যাত পোজে মেয়েটির ছবি তুলে দিলাম। মেয়েটি ঠিকানা দিয়ে চলে গেলো। জানলাম ও ঢাকার উঠতি গায়িকা। এই মুহূর্তে নাম মনে আসছে না।
আজ সকালে পুরোনো বাক্স থেকে বাংলাদেশের রোজের ছবিটা হটাৎ পেয়ে সৌমিত্রের কথা খুব মনে পড়ছে। ফটোগ্রাফির বাইরেও ও আমার খুব কাছের বন্ধু ছিলো। আমার জীবনের নানা ঘটনা শুনে বলেছিলো ও আমার জার্নির ডকুমেন্টারি করবে। শেষবার মুম্বাইয়ে ওর বাড়িতে রাত কাটিয়ে সকালে ফিরবো, ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘরে কোথাও নেই। সারারাত বকবক করলো, সকালে গেল কোথায়? এদিক ওদিক খুঁজে দেখতে না পেয়ে একটু বিরক্ত হয়ে রেডি হয়ে নীচে গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি ও পিছনের সিটে বসে আছে একটা ছোটো ব্যাগ নিয়ে। আমি দেখেই বললাম,” আরে তুমি এখানে! আমি উপরে খুঁজছি, আমার ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে, নামো তুমি।” বেশ বিরক্ত হয়েই ওকে বলে একরকম জোর করেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দিই। নেমে গিয়ে আমায় জড়িয়ে বলেছিলো, “অশোক আমায় নিয়ে চলো, তোমার সাথে কাজ করবো।”
ঝাপসা চোখে ওকে ঠেলে আমি গাড়িতে উঠে বসি। পিছনে তাকিয়ে দেখি ও নির্বাক ছোট ঝোলা নিয়ে আমার চলে যাওয়া দেখছে। গলার কাছটা কিরকম করে উঠেছিল। তারপর তো একদিন পৃথিবী ছেড়েই চলে গেলো। আমরা মানুষ। সেই ধর্ম মেনে কোনো কষ্টই চিরস্থায়ী হয়না। ফলে জীবন এগিয়ে যায়।
আজ কিরকম অদ্ভুত এই ছবিটা খুঁজে পেলাম। আর আজই সৌমিত্রের জন্মদিন। ও কোথাও নেই। কোনোদিন আসবেও না। কিন্তু স্মৃতিগুলো থেকে যায়। সেটাই মনে করায় সে আছে, আমার মধ্যেই আছে। আমি কোনোদিনই ওই অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিকদের মতো বলতে পারিনা যেখানেই থাকো ভালো থেকো। শুধু এটুকু বলতে পারি যে চলে যায় তার কোনো আস্তিত্বই এই পৃথিবীতে আর থাকেনা। কিন্তু সে থেকে যায় আমার মতো বেঁচে থাকাদের মনে জমে থাকা কিছু স্মৃতি হয়ে। তাই সৌমিত্রও আমার বেঁচে থাকার অস্তিত্বের মাঝে স্মৃতির সরণীতে গাঁথা হয়ে রয়ে আছে। আমার স্মৃতি যতদিন বেঁচে থাকবে ও আমার মনেই বেঁচে থাকবে।
শুভ জন্মদিন বন্ধু।