সকাল থেকেই ঘাটে ঘাটে চলছে তর্পণ, তীক্ষ্ম নজরদারি প্রশাসনের

0
570

পিয়ালীমুখার্জী, কলকাতা: ভাদ্রপদ পূর্ণিমা থেকে মহালয়া তিথি তে এসে সম্পূর্ণ হয় পিতৃপক্ষ। আজ মহালয়ার বিশেষ দিনের মহাক্ষনে শুভ সূচণা হয় দেবী পক্ষের। অর্থাৎ আমাদের পূর্ব পুরুষদের উদেশ্য তর্পণ এর পর মেতে ওঠেন দুর্গা পূজোর শুভ সূচনায়।

বৈদিক ক্যালেন্ডার অনুসারে দেবীপক্ষের আগে ১৫ দিন ধরে চলে পিতৃপক্ষ। এই সময়টায় স্রাস্ত্রের বিধান অনুসারে প্রয়াত পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার জন্য নির্দিষ্ট। মনে করা হয় এই সময় প্রয়াত পূর্বপুরুষরা দেবলোক ছেড়ে নিচের স্তরে নেমে আসেন সুক্ষ শরীরে, মর্ত্যলোকে এসে তাঁদের বংশধরদের হাত থেকে জল গ্রহণ করেন, তাতে আত্মা পরিতৃপ্ত হয়। কথিত এতে আমরা পুণ্য লাভ করি।

মহাভারতে বর্ণিত আছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণ মৃত্যু বরণ করে সুক্ষ শরীরে স্বর্গে গেলে তাকে খাদ্য হিসেবে সোনা দানা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা তো খাবার উপযুক্ত নয়। এর কারণ জানতে চাইলে কর্ণ কে পরমাত্মা জানান, সে দাতা কর্ণ নামে সুপরিচিত হলেও কখনো তাঁর পূর্ব পুরুষদের অন্ন জল দান করেননি, সোনা দানাই দান করেছিলেন তাই তাঁকে এগুলোই খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়েছে।

কর্ণ তখন জানান তিনি মৃত্যুর একদিন আগে তাঁর পূর্বপুরুষ সম্পর্কে জেনেছেন তাই তিনি সুযোগ পাননি অন্ন জল দান করার। তখন পরমাত্মা সিদ্ধান্ত নেন কর্ণ কে সুক্ষ শরীরে পনেরো দিনের জন্য মর্তে পাঠানো হয় পূর্ব পুরুষদের অন্ন জল দান করার জন্য। এই পনেরো দিন সেই থেকে পিতৃপক্ষ হিসাবে পরিচিত। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা থেকে অশ্বিন মাসের অমাবস্যা এই ১৫ দিন ধরে চলে পিতৃ তর্পণ। এই সময় তাতেই কর্ণ মর্তে ফিরে তর্পণ করেছিলেন। মহালয়া তিথি তাই শ্রাদ্ধের সমতুল্য। তাই নৈতিক ভাবে একে শুভ মহালয়া বলা যায়না। ঠিক যে ভাবে আমরা শুভ শ্রাদ্ধ বলি না। ভ্রান্ত ধারণা প্ৰচলিত আছে। তাই এই তিথি কে শুভ দেবীপক্ষ বলা যায়।
তর্পন প্রকার : ১) পিতৃ তর্পন । ২)মাতৃ তর্পন । ৩) গুরু তর্পন । ৪) ঋষি তর্পন । ৫) দিব্য পিতৃতর্পন । ৬) যম তর্পন । ৭) ভীষ্ম তর্পন । ৮) বাম তর্পন । ৯)লক্ষণ তর্পন ১০) শূদ্র তর্পন 

পিতৃপক্ষের শেষ হলে আসে দেবীপক্ষ, যাকে মাতৃপক্ষও বলা হয়ে থাকে। কারণ এই দেবীপক্ষে দেবী মায়ের আবাহন ঘটে। দেবী দুর্গা মহাশক্তি মহামায়া শ্রী আদি আদ্যাশক্তির কেন্দ্রীভূত চিত্‍-শক্তি। দেবী হলেন সত্ত্ব-রজো-তমো, এই ত্রি-গুণের অধিষ্ঠাত্রী এবং ত্রিগুণাত্মিকা। তিনি ত্রিগুণে বিরাজিতা আবার ত্রিগুণাতীতা। তাঁর বাহন সিংহ হল রজোগুণের প্রতীক, অসুর হল তমোগুণের প্রতীক। দেবী মহামায়ার নবরূপ নবদুর্গা নামে পরিচিত।

পার্বতী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুশ্মাণ্ড, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী। মহালয়ার পরের দিন প্রতিপদ থেকে মহানবমী তিথি পর্যন্ত দেবী আরাধিতা হন এই নবরূপে। এই দেবী আরাধনার মাধ্যমে যুগে যুগে আমাদের সমাজে, সংসারে প্রতিটি নারীকে এক মান্যতায় প্রতিষ্ঠিত করার পবিত্র অনুভূতি রয়েছে। সেই বোধের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান থেকেই স্বামী বিবেকানন্দ শুরু করেছিলেন ‘কুমারীপূজা’, যে পূজা সেই প্রাচীন কালে ঋষি-মুনিদের আশ্রমে অনুষ্ঠিত হত। আসলে নিত্যদিনের সংসারে-সমাজে প্রতিটি নারীর মধ্যেই তো দেবী দশপ্রহরণধারিনী মা দুর্গা বিরাজিতা – মা রূপে, ভগিনী রূপে, স্ত্রী রূপে, কন্যা রূপে, সহকারিনী রূপে, বিভিন্ন রূপে।

মহালয়া হল পিতৃপক্ষ এবং দেবীপক্ষের মহা সন্ধিক্ষণ। মহালয়ার অর্থ হল মহত্‍ আলোয় পিতৃপুরুষদের প্রতি ‘তর্পণ’ পূর্বক শ্রদ্ধা নিবেদন। দেবী পক্ষ শেষ হয় দশমী তে অর্থাৎ দশেরা বা নবরাত্রির শেষে।

পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবী পক্ষের সূচনায় সকাল থেকেই কলকাতা সহ জেলায় জেলায় শুরু হয়েছে তর্পণ। গঙ্গা তো বটেই, অন্য নদীর ঘাটেও সকাল থেকে শুরু হয়েছে তর্পণ। পিতৃ পুরুষদের তৃপ্ত করতে ভিড় বিভিন্ন ঘাটে ঘাটে। করোনার বিধিনিষেধ থাকায় কড়া সতর্কতার মধ্যেই চলেছে তর্পণ।

রয়েছে কড়া নিরাপত্তাও। তৈরি রয়েছে কলকাতা পুলিশ ও রিভার ট্রাফিক পুলিশও। কলকাতায় গঙ্গার ২৬টি ঘাটে তর্পণের জন্য ভিড় করেন সাধারণ মানুষ।

হাওড়ার বিভিন্ন ঘাটে ঘাটে চিত্রটা একই। শিবপুরের রামকৃষ্ণপুর ঘাট, হাওড়া ময়দানের তেলকল ঘাট, সালকিয়ার বাধাঘাট, ঘুসুড়ির গোসাইঘাট, শিবপুরের শিবপুর ঘাট সহ একাধিক ঘাটে এদিন কয়েকশো জনসমাগম হয়। পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে চলে তর্পণ। হাওড়া সিটি পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিটি ঘাটে যেমন নজরদারি চালানো হয়, তেমনই গঙ্গায় নামানো হয় স্পিডবোট ও নৌকা। পুলিশের পাশাপাশি ঘাটগুলিতে নজরদারি চালায় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরাও। বেশ কয়েকটি ঘাটে চলে ড্রোনের নজরদারিও। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে চলছে মাইকিংও।

বিভিন্ন জেলাতেও ভোর থেকেই শুরু হয়েছে তর্পণ। মেদিনীপুর শহর সংলগ্ন কাঁসাই নদীর তীরে গান্ধীঘাটে পিতৃ তর্পণে ভিড় চোখে পড়ে। তবে অন্য বছরের তুলনায় এবছর ভিড় কম রয়েছে বলে জানাচ্ছেন অনেকে। এখানেও কড়া নজরদারি চালাচ্ছে প্রশাসন। রয়েছে সিভিল ডিফেন্স ও স্পিডবোট।

বনগাঁর ইছামতি নদীর আপনজন ঘাটেতও চলল তর্পণ। করোনা বিধি-নিয়ম মেনেই তর্পণ সারলেন পুণ্যার্থীরা। এখানেও নজরদারি চালানো হচ্ছে প্রশাসনের তরফে। দূর-দূরান্ত থেকেও লোক এসে তর্পণ সারছেন এদিন।

Previous articleDurga Puja: প্রতিমার চক্ষুদানে মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী রূপে প্রতিষ্ঠিত হন দেবী
Next articleদেশের সময় পুজোর ফ্যাশন: আজকের মডেল সুনয়না মুখার্জী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here