পিয়ালী মুখার্জী, কলকাতা: কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো গুলির মধ্যে অন্যতম হল সাবর্ণ রায় চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো। জমিদার লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার, স্ত্রী ভগবতী দেবীর ইচ্ছেয় ১৬১০ সালে এই পুজোর সূচনা করেন। বাড়ির সদস্য দেবর্ষি রায় চৌধুরী কাছে জানা গেল সাবর্ণ রায় চৌধুরীর বৃহত্তর পরিবারের পুজো ও পারিবারিক নানা ঘটনা প্রবাহ, বিধি ও অজানা বহু ইতিহাস। দেখুন ভিডিও:
সাবর্ণ রায় চৌধুরী বাড়ির দূর্গা মোট ৮টি বাড়িতে পূজিত হয়। লাল বা হালকা সোনালী রং-এর হয়ে থাকে প্রতিমার মুখ । এই বাড়ির পুজোর চালচিত্রে রয়েছে ছিন্নমস্তা, বগলা, মাতঙ্গী, কমলাকামিনী-সহ দশমহাবিদ্যা।
৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ভারতের সম্রাট আদিসুর নামে এক দক্ষিণ দেশীয় রাজপুরুষকে নিযুক্ত করেন অবিভক্ত বঙ্গ পরিচালনার জন্যে। সে সময় বঙ্গ হিন্দু ধর্মের ক্ষয়িষ্ণু দশা। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের এই রাজা দেখলেন যে এখানে সার্থক গোত্রিক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ নেই। যারা আছেন তাঁরা সারস্বত ব্রাহ্মণ। এ অবস্থায় তিনি পাঁচ ব্রাম্মণকে নিয়ে এলেন এই বঙ্গে। এঁরা হলেন শ্রী হর্ষ, ভট্ট নারায়ন, দক্ষ,ছন্দ ও বেদগর্ভ। এদের গোত্র যেমন ভিন্ন, উপবীতও ভিন্ন। গোত্র হোল সাবর্ণ, শাণ্ডিল্য, কাশ্যপ, ভরদ্বাজ ও বাতস্য। আর উপাধি হল পন্দিত(পান্ডে),চতুর্বেদী( চৌবে), ত্রিবেদী(তেওয়ারী), দ্বিবেদী(দুবে)। মিশ্র(মিশির)। এই পাঁচ ব্রাহ্মণের জীবিকা নির্বাহের জন্য আদিশূর ৫৬ টি গ্রাম এঁদের জায়াগির দিলেন। এদের মধ্যে বেদ গর্ভ পেলেন অজয় নদের ধারে গঙ্গারাম অঞ্চলে। আর অন্যান্যরা পেলেন রাজসাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এই ব্রাহ্মণরা বেদ ও বেদান্তের অধ্যাপনা করতেন বলে কালক্রমে উপাধ্যায় বলে পরিচিত হলেন। আর গঙ্গারামে থাকতেন বলে হলেন গঙ্গোপাধ্যায় ।
বড় বাড়ির মেয়ে মল্লিকা রায় চৌধুরী মজুমদার জানান তাদের পুরোনো কিছু ইতিহাস। বারো ভুঁইয়ার সময় যখন বাংলার রাজনীতির আকাশে নানা পটপরিবর্তন হচ্ছে, লক্ষ্মীকান্তের উত্থান সেই সময়। তখন কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চল ছিল যশোহরের মধ্যে। আর এই যশোর এস্টেটের দায়িত্বে ছিলেন বারো ভুঁইয়ার বসন্তরায় এবং বিক্রমাদিত্য। বিক্রমাদিত্যর পুত্র প্রতাপাদিত্য এবং লক্ষীকান্ত, দু’জনেই ছিলেন অমায়িক, সদাহাস্যমুখ বসন্তরায়ের অত্যন্ত কাছের মানুষ। লক্ষ্মীকান্ত ছিলেন যশোর এস্টেটের মহামন্ত্রী।
বিক্রমাদিত্য মারা যাওয়ার সময় পূর্ববঙ্গ, অর্থাৎ যশোহরের দিক পেলেন প্রতাপ, পশ্চিম দিক পেলেন বসন্তরায় পিতার মৃত্যুর পরে তিনি অত্যন্ত স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেন তিনি। হত্যা করলেন পিতা সমান বসন্তরায়কে। এর কিছু দিনের মধ্যেই প্রতাপকে দমন করতে মানসিংহকে পাঠান আকবর। প্রতাপ পরাজিত হলে ১৬০৮-এ লক্ষ্মীকান্তকে হালিশহর থেকে আটটি পরগনার নিষ্কর জমিদারি স্বত্ত প্রদান করেন মানসিংহ। সেই সঙ্গে পান রায়চৌধুরী উপাধি। এর আগে হালিশহরে বছর দু’য়েকের জন্য দুর্গাপুজো করলেও পরে বড় আকারে বড়িশাতে পুজো শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী।
আগে দুর্গার গাত্রবর্ণ এখনের মতো ছিলো না, দেবীমূর্তির সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী বা কার্তিক, গণেশ ছিলেন না। দেবীকে মূলত চণ্ডীরূপে পুজো করা হত। এই প্রথম দেবীকে সপরিবার আবাহন করলেন লক্ষ্মীকান্ত। কার্তিকের চেহারায় কিছু পরিবর্তন আনা হল। পণ্ডিতরা বিধান দিলেন, দেবীর গায়ের রং হতে হবে স্বর্ণাভ বা শিউলি ফুলের বোঁটার মতো। গণেশের গায়ের রং হয় লাল। অসুরের সবুজ। দেবীর এক দিকে থাকেন রঘুপতি, অন্য দিকে শিব।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের মোট আটটি বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। প্রধান পুজোটি হয় বড়িশা আটচালায়। বাকি পুজোগুলি হয় আটচালা বাড়ি, বড় বাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকী বাড়ি, কালীকিঙ্কর ভবনে। আগে এই বাড়ির পুজোয় ১৩টি ছাগল ও ১ টি মোষ বলি হত। সাবর্ণ রায় চৌধুরী-র বাকি সমস্ত বাড়িগুলিতে আমিষ ভোগের আয়োজন করা হয়। এই পরিবারের সদস্য দেবর্ষি রায়চৌধুরী জানান, লক্ষ্মীকান্তের নাতি বিদ্যাধর রায়চোধুরীর সময় এই পরিবারের পুজোতে ত্রিধারাসঙ্গম হয়।
অর্থাৎ, শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব— এই তিন মত মিলে যায় পুজোতে। পুজোর চালচিত্রে রয়েছেন ছিন্নমস্তা, বগলা, কমলাকামিনী, মাতঙ্গী, অর্থাৎ দশমহাবিদ্য। বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি ও নিমতার বাড়িতে সিংহের মুখ হয় ঘোটক আকৃতির। যা বৈষ্ণব মতানুযায়ী হয়। বাকি বাড়িতে সিংহের মুখ হয় সিংহের মতোই। পুজোর চালচিত্রে রয়েছেন ছিন্নমস্তা, বগলা, কমলাকামিনী, মাতঙ্গী, অর্থাৎ দশমহাবিদ্যা এবং সেই সঙ্গে রয়েছেন রাধাকৃষ্ণ। বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি ও নিমতার বাড়িতে সিংহের মুখ হয় ঘোটক আকৃতির। যা বৈষ্ণব মতানুযায়ী হয়। বাকি বাড়িতে সিংহের মুখ হয় ।আগে এই বাড়ির পুজোয় ১৩টি ছাগল এবং একটি মোষ বলি হত। এখন পশুবলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার বদলে কুমড়ো, আখ এই সব বলি হয়।